Header Ads

চারটি অনুগল্প (মাহবুবা সিদ্দিকা)


Mahbuba
লেখিকা
মাহ
মাহবুবা সিদ্দিকা



জীবন

          নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে পড়ালেখা করে ভালো রেজাল্ট করা অনেকটাই স্বপ্নের মতো। সেই স্বপ্নটা বাস্তবায়িত হয়েছিলো আমার জীবনে। এইচ এস সি পরীক্ষায় ব্যবসা বিভাগ থেকে জিপিএ ফাইব পেয়েছিলাম।যেহেতু আমার বাবা, বড় ভাই কেউ নেই তাই ভেবেছিলাম কোনোরকমে ইন্টার পরীক্ষা দিয়ে আর পড়ালেখা করবোনা। কিন্তু এতো ভালো রেজাল্ট হওয়ার পর কলেজের স্যারদের অনুপ্রেরণায় সাস্টে এডমিশন টেষ্ট দিয়ে দেই। ভাগ্যক্রমে একাউন্টিং সাবজেক্ট নিয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ পেয়ে যাই। দূর সম্পের্কর একজন বিত্তবান আত্নীয়ের আর্থিক সহযোগিতায় ভর্তি হই দেশের অন্যতম এই বিদ্যাপীঠে।

সুনামগন্জের পানি বহিত নিচু এলাকা থেকে চলে আসলাম স্বপ্নের শহর সিলেটে। দূর্ভাগ্যবশত ভার্সিটির হোস্টেলে সিট পাওয়া হয়নি আমার। যেহেতু এই শহরে আমার কোনো আপনজনের বসতি নেই তাই কলেজের প্রিয় একজন স্যারের কাছে পরামর্শের জন্য দ্বারপন্ন হলাম। তিনি সাস্টের একজন বড় আপুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন যিনি দু'বছর আগে আমাদেরই কলেজ থেকে পাশ করে সাস্টে পড়াশোনা করছেন। আপুর সহযোগিতায় আমি তিনি যে আবাসিক হোস্টেলে থাকেন সেখানে উঠলাম। লুৎফুন্নেছা মহিলা হোস্টেল। আমাদের ভার্সিটির পাশেই।

গ্রামে থাকা অবস্থায় স্কুল জীবন থেকে কলেজ জীবন পর্যন্ত আমার পড়ালেখায় আর্থিক কোনো কষ্ট হয়নি। স্যারদের সাহায্য নিয়ে এতোদূর চলে আসছি। কিন্তু এখনতো আমাকে কিছু একটা করতে হবে। নিজের থাকা-খাওয়া এবং পড়াশোনার ব্যয় বহনের জন্য। তাছাড়া বাড়িতে মা, ছোট দুটো ভাই একটি বোন আছে। মা সেই বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে মানুষের বাড়িতে কাজ করে আসছেন।আমার শহরে আসাতে আমার অসহায় পরিবারের এই ধারণা হয়েছে যে আমি এখানে অনেক টাকা ইনকাম করতে পারবো। আমার উচ্চ শিক্ষা নিয়ে তাদের বিন্দু মাত্র ধারণা নেই। যে আপু আমাকে হোস্টেলে নিয়ে এসেছিলেন তার সহায়তায় আমি দুটো টিউশনি পেয়ে গেলাম। তার উপকার গুলো আমার পক্ষে কোনোদিন ভোলার মতো নয়।
আমার ছোটখাটো এই ইনকাম দিয়ে আমার দিন ভালোই চলছিলো। মাঝে মাঝে মাকে কিছু টাকা দিতে পারতাম।

এভাবে একবছর কেটে গেলো। আমি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হবো ঠিক এই সময়টায় আমার মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়েন। ভর্তির জন্য জমানো টাকাটা মায়ের চিকিৎসার জন্য দিয়ে দেই। কিন্তু মায়ের অবস্থা এতোটা ভালো হয়নি। মা প্রেশার এর রোগী। হঠাৎ করে প্রেশার বেড়ে যায়। বেহুশ হয়ে পড়ে যান। তাই ডাক্তার তাকে বলেছে বেশি কাজ না করতে আর চাপ না নিতে। সেজন্য মাকে বলেছি ঘরে থাকতে কারো বাসায় কাজে না যেতে। পরিবারের পুরো দায়িত্ব এখন আমার হাতে। সেজন্য সিদ্ধান্ত নিলাম কোনো একটা চাকরী করবো। মাকে রেগুলার সেবনের জন্য ডাক্তার একটা ঔষধ দিয়েছে। এটা ফুরিয়ে গেলে মায়ের প্রেশার বেড়ে যায়। তাছাড়া আমার ভর্তির টাকাটা এখনো দিতে পারি নাই। আমি যে স্টুডেন্টদের কে পড়াই তাদের একজনের বাবা খুবই গণ্যমান্য ব্যক্তি। তাদের পরিবারের সবাই অত্যন্ত স্নেহ করেন আমাকে। তাই আন্কেল কে করজোড় করে বললাম আমাকে একটা চাকরীর সন্ধান দেওয়ার জন্য।

ভাগ্য ভালো ছিলো আমার, তাই এক সপ্তাহের ভিতর আন্কেল আমাকে একটা চাকরীর সন্ধান
দিয়ে দেন। ফুলকলি কোম্পানির একটা শাখাতে। বিকেল চারটা থেকে রাত নয়টা পর্যন্ত।একবছরে শহরের রাস্তা ঘাট সম্পর্কে ধারণা মুটামুটি হলেও আমার চাকরী যে জায়গায় হয়েছে সে জায়গা সম্পর্কে এতোটা ধারণা নেই। আমার হোস্টেল থেকে অনেক দূরে সোবহানীঘাটে ফুলকলির এই শাখাটা। ভার্সিটি থেকে এসে প্রাইভেট পড়িয়ে প্রথম দিনের মতো চাকরীতে গেলাম।আন্কেল বলেছেন, রাতের এই সময়ে আমার হোস্টেলর এই দিকে রিক্সা যায়না।কিন্তু ফুলকলির সামনেই লোকাল সি এন জি পাওয়া যায়। পনেরো মিনিটের ভিতরে আমার হোস্টেলর সামনে পৌঁছে দিবে। চাকরীর প্রথম দিন হিসাবে রাত নয়টার সময় ছুটি দিয়ে দিলো। বাইরে বের হয়ে অনেকগুলো সি এন জি দেখতে পেলাম। আন্কেল এর কথামতো একজন ড্রাইভার কে টিলাগড় যাবেন না কি? বলার সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলো।

ড্রাইভার যিনি উনার বয়স প্রায় ৪৭-৫০ বৎসর হবে।ড্রাইভিং সিটের দুই পাশে আর দুজন ব্যক্তি ছিলো।এদের এক জনের বয়স ড্রাইভারের বয়সের মতো হলেও আরেকজন পঞ্চাশর্ধো হবে। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে বাড়ি ফিরা শ্রমিক মনে হচ্ছে তাদেরকে। ড্রাইভারের সাথে কথা বলার ভঙ্গিতে বোঝা যাচ্ছে তারা পুর্ব পরিচিত। হয়তো তারাও ড্রাইভার। মালিকের গাড়ি কোথাও পার্ক করে ক্লান্ত দেহ নিয়ে একসাথে বাড়ি ফিরছে। আল্লাহর নাম নিয়ে গাড়িতে উঠে বসলাম।আমার বয়সী মেয়ে হয়তো তাদের ঘরে আছে।

গাড়িতে উঠার পর তাদের গাড়ি চালানোর স্পীড আর একে অপরের প্রতি যে ইঙ্গিত দিচ্ছিলো তা আমার কাছে ভালো ঠেকেনি। আমি গাড়ি থেকে নামার উপায় খুজছিলাম।তারা সম্ভবত কোনো আবাসিক এলাকার ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলো তাই দোকানপাঠ বেশি একটা নজরে আসছেনা। যে দু একটা আছে সেগুলো বন্ধ। দূর থেকে দেখলাম দূরে একটা জায়গায় বাইরে লাইট জ্বলছে। সম্ভবত কোনো কোচিং সেন্টার হবে। আজ হয়তো তাদের কোনো প্রোগ্রাম ছিলো তাই বাইরে কাগজ বেলুন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ড্রাইভারকে বললাম, এখানে একজন স্যারের সাথে দেখা করতে হবে পাঁচ মিনিট লাগবে, গাড়িটা একটু থামান।কিন্তু ওরা আমার কথা শুনলোনা। আমি কোনোরকমে লাফ দিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। নিজেকে টেনে সামলে কোচিং সেন্টারের ভিতরে প্রবেশ করলাম। মনে মনে এটাও ভাবছিলাম যদি ভিতরে কেউ না থাকে আর ড্রাইভাররা যদি পিছু পিছু এসে যায়। ভিতরে প্রবেশ করে দেখলাম দুজন ছেলে আছে। হাফ ছেড়ে বাচলাম।

কষ্ট করে মুখ থেকে একটাই শব্দ বের করলাম পানি খাবো। তারা পানি খাওয়ালো। এরপর তাদেরকে পুরো ঘটনা খুলে বললাম। তাদের একজন বাইরে গিয়ে দেখলো কোনো সি এন জি নেই। তখন তারা বললেন, আমার ভার্সিটির বা চাকরীর কার্ড দেখানোর জন্য। যেহেতু আমি টিউশনি থেকে এসেছিলাম এবং চাকরীর প্রথম দিন ছিলো তাই আমার কাছে কোনো আইডি কার্ডই ছিলোনা। সেজন্য ওরা আমার কথা বিশ্বাস করতে চাইতেছেনা। পরে তারা বললো আমার হোস্টেলর আপুকে কল দেওয়ার জন্য , তাকে কল দিলাম কিন্তু তিনি রিসিভ করেননি। আমার পরনে বোরকা ছিলো,শপ থেকে বের হওয়ার সময় হিজাব দিয়ে নেকাব করেছিলাম।

তাই তারা একটু সন্দেহের নজরে তাকাচ্ছে। বোরকা-নেকাব পড়া একটা মেয়ে বলতেছে সে রাস্তা চিনেনা, কোনো আইডি কার্ড নেই সাথে, পরিচিত কেউ নেই এই শহরে। এসব কিছু মিলিয়ে তাদের কাছে মনে হচ্ছে আমি কোনো ক্রাইম করে আসছি হয়তো। অথবা তাদেরকে কোথাও ফাসাতে চাচ্ছি। অবশেষে তারা বললেন, আপু যেহেতু কল রিসিভ করছেনা তাহলে তারা একটা গাড়িতে আমাকে তুলে দিবেন আমি যেনো বাসায় চলে যাই। কিন্তু আমার ভিতরে এতোটা ভয় জাগছিলো যে তাদের কথায় আমি রাজী হলাম না। কাকুতি মিনতি করা শুরু করলাম আমাকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার জন্য। কয়েক মিনিট পর তারা যে দুজন ছিলেন তাদের একজন রাজী হলেন আমাকে হোস্টেল পৌঁছে দেওয়ার জন্য। বাইরে বের হয়ে তিনি গাড়িতে না উঠে আমাকে একটা ফার্মেসীতে নিয়ে গেলেন। তখন আমি লক্ষ করলাম গাড়ি থেকে যে লাফ দিয়ে পড়েছিলাম আমার হাতের কনুই এর অনেক অংশ কেটে গেছে। কপালে অনেকটা জখম হয়েছে। আমি এই ক্ষত নিয়ে নিজেকে সামলে দৌড় দিলাম কিভাবে। হয়তো সৃষ্টিকর্তা তখন এক আর্শ্বয্য ক্ষমতা দিয়েছিলেন।

ফার্মেসি থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে একটা রিকশাতে উঠলাম। বসে বসে চিন্তা করছি আন্কেল বললেন এদিকে এই সময়ে রিক্সা চলেনা লোকাল সি এন জি চলে। তাহলে এখন রিক্সা যাচ্ছে কেনো? ক্লিয়ার হওয়ার জন্য সাথে থাকা ভাইয়াকে আন্কেলের বলা কথা গুলো বললাম। সে বললো, ফুলকলির সামনের বামের সি এন জি স্টেশন থেকে টিলাগড় এর লোকাল সি এন জি যায়। আপনি ডানের সি এন জি স্টেশনের ড্রাইভার কে টিলাগড় যাওয়ার কথা বলেছেন।উল্টো দিকের রাস্তা বলায় তারা বুঝে গেছে আপনি রাস্তা চিনেননা।তাই আপনার সাথে খারাপ কাজ করার চেষ্টা করেছে। ঐদিকে রিক্সা যায়না সময় এটা সত্য। কিন্তু এদিক দিয়ে রিক্সার চলাচল থাকে। কেনো জানি তাকে জিজ্ঞেস করতে মন চাইলো তাদের দুজনের মধ্যে অন্যজন আমাকে সন্দেহজনক মনে হওয়ায় বাসায় পৌঁছে দিতে রাজী হলোনা। তিনি কেনো রাজী হলেন?এই প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক বললেন, আপনার মতো আমার একটা বোন আছে একাকী কলেজে যায়।তার কথা চিন্তা করে আপনাকে পৌঁছে দিতে রাজী হয়েছি।

বুকের ধকধকানিটা একটু কমছে।রিক্সায় বসে বসে চিন্তা করছি যেখানে বাবার বয়সী তিনজন মানুষ শ্লীলতাহানির চেষ্টা করলো সেখানে ২৫-২৭ বছর বয়সী একটা যুবক ছেলে নিরাপদে বাসায় পৌঁছে দিচ্ছে। আসোলে এই দুনিয়াটা খুবই অদ্ভুত। একটু পর কিঞ্চিত বিরক্তি নিয়ে ভদ্রলোক আমাকে বললেন রাস্তাঘাট ভালোভাবে চেনেননা, দুনিয়ার অবস্থা খারাপ কি দরকার ছিলো আপনার রাত্রে চাকরী করার। পরিবারের অবস্থা, মায়ের কথা এসব বলাতে ভদ্রলোক নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আমার মতো হয়তো আরো অনেক মেয়ে আছে যারা বেচে থাকার জন্য এই শহরে অনেক ধরনের সংগ্রাম করছে। নিরাপত্তাহীনতায় ভোগছে। মনে মনে নিজেকে বললাম, ইশ, আমার যদি এরকম একজন বড় ভাই হতো, তাহলে হয়তো এরকম কষ্ট করতে হতোনা।

 

দৃষ্টি ভঙ্গি

          যে রিয়াদ আজ তুমি মুন কে একটু বেশি সময় পড়াইও কালতো ওর এক্সাম। আন্টির মুখের উপর না করতে পারলামনা,তাই মুনকে এক ঘন্টার বদলে দেড় ঘন্টা পড়িয়ে তাড়াহুড়ো করে সারাদের বাসায় গেলাম। কলিংবেল চাপতেই সারার মা দরজা খুলে আমাকে কোনো কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই বলা শুরু করলেন,তোমার ভিতর কি টাইম সেন্স নেই। কাল আমার মেয়ের পরীক্ষা। আর তুমি আধা ঘণ্টা লেট করে আসছো। উনার ক্লাস থ্রির বাচ্চার জন্য এরকম প্রেশার নিতে দেখে মনে হলো, আমাদের মা আমরা চার ভাইবোন কে মানুষ করতে হয়তো এতোটা চাপ নেননি।

মাঝে মাঝে কারো প্রতি এতোটা রাগ হয় যে ইচ্ছে করে টিউশনি করানো ছেড়ে দেই।কিন্তু নিজের পড়ালেখার ব্যয় ছোট ভাইয়েদের খরচ এগুলো মনে হতেই সব রাগ, গ্লানি মুছে দিনশেষে বাড়ি ফিরতে হয় আমাদের মতো টিউটরদের।

যেহেতু এই টিউশনিটাই এখন আমার পেশা, সেজন্য মাস শেষে বেতনের অপেক্ষা অবশ্যই আমার থাকে।একদিন সারাকে পড়ানোর জন্য গিয়েছি, তখন আন্টি বললেন, বাবা, সারাকে আজ একটু আগে ছুটি দিয়ে দিও। মানে আমরা আজকে একটু বাইরে খাওয়া দাওয়া, ঘুরাফেরার জন্য বেরোবে। আর শোনো, এই মাসে না একটু সমস্যায় আছি,তোমার বেতনটা দিতে একটু দেরী হবে। মনে মনে বললাম, শপিং, ঘুরাফেরার মতো জরুরি কাজ গুলো শেষ হলে আমার বেতনটা দিয়েন।আমাদেরতো আর টাকার প্রয়োজন নেই।

এগুলোতেই শেষ নয়। রেস্টুরেন্টে যদি কোনো দিন ফ্রেন্ডদের সাথে যাই। ওরা বলে, "তুই তো চাকরী করিস,বিলটা তুই দেয়না " এই ফ্রেন্ডটাই বাইরে এসে আমার ভালোবাসার মানুষকে বলে "তুমি এই ছেলেটার সাথে সম্পর্ক করো" ওর বাবার টাকা পয়সা কিছুই নেই। সে টিউশনি করায়।আচ্ছা, আমি জানি, আমার বাবার টাকা নেই। কিন্তু আমার একটা স্ট্রন্গ পার্সোনালিটি আছে। আমি অন্যের উপরে নির্ভর নই। তিন থেকে চার বছর পর, সাত - আট লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়ে চাকরী করে সারা জীবনতো আমি হারাম টাকা ইনকাম করতে পারবোনা তাইনা?আমি বুঝিনা। ছাত্র জীবনের এই ছোটখাটো ইনকাম করে নিজের দায়িত্ব নিজে নেওয়াকে মানুষ এতো ছোট করে কেনো দেখে। কোনো ছেলে যদি রেস্টুরেন্টে কাজ করে, আর তাকে কেনো মেয়ের সাথে দেখা যায়। তাহলে তার বন্ধুরাই একে অপরকে বলে, "এই দেখ, রেস্টুরেন্টে কাজ করে, আর মেয়ে সাথে নিয়ে ঘুরছে। আচ্ছা একটা মানুষ রেস্টুরেন্টে কাজ করায় কি তার কাউকে ভালোবাসার অধিকারটাই চলে গেছে।

সময় আছে এখনো। দৃষ্টি ভঙ্গি পাল্টান। টিউশনি হলো একটি মহৎ হালাল পেশা।কারো বেতনভুক্ত চাকর নয়। অনেক মেয়ে আছে যাদের পরিবার সচ্ছল তারপর প্রাইভেট পড়ায়। বান্ধবীরা এটা নিয়ে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে।আমি বলি কি,যারা পড়ায় তাদের কিন্তু এম বির টাকার জন্য, কসমেটিকস এর টাকার জন্য বাবার কাছে হাত পাততে হয়না।ওদের মা বাবার ভরসা থাকে ওদের উপর।মা বাবা বুঝতে পারে, তার মেয়ে জীবনে কিছু একটা হলেও করতে পারবে।আর তোমরা যারা ড্যডির প্রিন্সেস।কোনো রকম অনার্স শেষ হতেই বাবা এসে বলেন, তোমার জন্য ছেলে দেখেছি তোমাকে রাজি হতেই হবে। সবশেষে তোমার বিত্তবান বাবাই তোমাকে বোঝা মনে করেন। তোমার বাবা জানেন,তোমাকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা।

এই পৃথিবীতে কোনো পেশাই ছোট নয়। শুধু ছেলে মেয়ে না। এই সমাজে কিছু অভিবাবক আছেন যারা টিউটেরদের কে পর্যাপ্ত সম্মান দিতে জানেননা। এমন ব্যবহার করেন যেনো একজন শিক্ষকের তাদের বাচ্চা পড়ানো ছাড়া আর কোনো কাজ নেই মনে রাখবেন, টিউটর আপনার বাচ্চার শিক্ষক, সে কেয়ার টেকার না।

এছাড়া আরো কিছু লুতুপুতো টাইপ মা বাবা আছেন। তাদের ধারণামতে ছাত্রবস্থায় বাচ্চা স্বভালম্বী হওয়া গুনাহ এবং লজ্জার কাজ। বাবার টাকা থাকলে যে তার ছেলে মেয়ে টিউশনি বা অন্য কোনো পার্ট টাইম জব করতে পারবেনা। এরকম ধারণা যে মা বাবা পোষণ করেন, ধিক্কার জানাই তাদেরকে। এরকম ধারণা নিয়ে যদি মনে করেন, আপনাদের বাচ্চারা ভবিষ্যতে স্বাবলম্বী বা বিবেকবান মানুষ হবে তাহলে ভুল ভাবছেন। স্বাবলম্বী হওয়ার সময় কিন্তু বয়স পঁচিশের উপর যাওয়ার পর হয়না। স্বভালম্বী হতে হয়ে প্রাপ্ত বয়স্ক হওয়ার একদম শুরুতেই।

বাবার উপার্জন দিয়ে আর কতো দিন চলবে। নিজে কিছু একটা করুন।বাবার টাকা দিয়ে বাইক,কসমেটিকস, ক্রয় করে নিজেকে বড়লোক প্রমাণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। ১৯-২০ বছর বয়স থেকে যদি নিজের দায়িত্বটা নিতে পারো তাহলে বিশ্বাস করো,তোমাকে নিয়ে তোমার বাবার আর কোনো চিন্তা করতে হবেনা।এইটুকু ভরসা তৈরী করতে পারো। আর যে অভিবাবকরা মনে করেন, আমার টাকা আছে, আমার বাচ্চা কেনো পার্ট টাইম জব করবে তাদেরকে আসোলে আমার কিচ্ছু বলার নেই। শুধু এটুকুই বলবো ভবিষ্যতে আপনার বাচ্চা আপনার উপর নয় বরং আপনি আপনার বাচ্চার উপর নির্ভর হবেন।বাচ্চার ভিতরের মনুষ্যত্ব কে জাগিয়ে তুলুন।এমন আদর করবেনা যেনো শেষ পর্যন্ত আপনাকেই আফসোস করতে হয়।

 

  সময় ও আমরা

.  ১৯৮০ সালে হারিছ মিয়া ছিলেন প্রচুর জমির মালিক। একদিন তার পাশের গ্রামের বন্ধু জমিদার ফয়েজ মিয়া তার বাড়িতে বেড়াতে আসলেন।গল্পসল্পের ফাঁকে ফয়েজ মিয়া লক্ষ্য করলেন হারিছ মিয়ার চতুর্থ কন্যা সুফিয়া খাতুন উঠানে খেলতেছেন।তার পছন্দ হয়ে গেলো সুফিয়া খাতুন কে।বন্ধুকে জানাতেই বন্ধু রাজি হয়ে গেলেন।১৩ বছর বয়সে বিয়ে কি তা বুঝে উঠার আগে সুফিয়া খাতুন ফয়েজ মিয়ার তৃতীয় বউ হয়ে স্বামীর বাড়িতে চলে যান।জ্বি, আপনে বলতে বলতে শেষ বয়সে সুফিয়া খাতুন ভুলেই গেছিলেন তার স্বামীর নাম কি ছিলো।

২. ১৯৯০ সাল।দিলারা বেগমের বাবা ছিলেন এলাকার মোড়ল।তাদের ঘরে কাজের জন্য ছিলেন বাবার অনেক কর্মচারী।বাবার সবচেয়ে বিশস্ত কর্মচারী মখলিছ এর ব্যবহার, আচারনে মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যান দিলারা বেগম।কয়েক দিন পর মখলিছ বলেন তাকে,"সখী কি করে তোমাকে করবো গো মোর।আমি যে তোমার মোড়ল বাবার ঘরের টুল"।দিলারা বেগমের বিয়ে অন্যত্র হয়ে গেলেও মখলিছ কে মনে রেখেছিলেন তিনি।শেষ বয়সে মখলিছের জন্য তার মন ছ্যঁৎ
করে উঠতো।এদিকে চোখের পানি ফেলতে ফেলতে জীবনে বিয়ে করেননি মখলিছ।

. ২০০০ সাল।স্কুলের নবম শ্রেণিতে পড়তেন জামিলা নাজিম।ভালোলাগা থেকে গঢ়ে ওঠে দুজনের ভালোবাসার সম্পর্ক। মাঝে মাঝে হতো চিঠি আদান প্রদান। হাবুডুবু খাওয়া তাদের প্রেমের সম্পর্ক পরিবারে এবং গ্রামে ছড়াছড়ি হয়ে যায়।বাবা বন্ধ করে দেন জামিলার স্কুল যাত্রা।তাই দেখা হচ্ছিলনা নাজিমের সাথে।অবশেষে এক অন্ধকার রাত্রে পালিয়ে যান জামিলা নাজিমের হাত ধরে।

. ২০১০ সাল।ঢাকা ভার্সিটির ক্যম্পাস।কাওসার আড্ডা দিচ্ছিল তার ফ্রেন্ডদের সাথে।মনোযোগী ছাত্র কাওসারের লাভ এট ফার্স্ট সাইড হয়ে যায় জুনিয়ার ব্যচের মীম কে দেখে।এরপর শুরু হয় মীমের পিছু নেওয়া। ঘুম, খাওয়া পড়াশোনা সব হারাম হয়ে যায়।এসব দেখে মীমের মন মোমের মতো গলতে থাকে।শুরু হয় অনেক গুলো স্বপ্ন নিয়ে তাদের হাত ধরা।দুই বছর পর মীমের জন্য নিয়ে আসা বিয়ের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিতে দিতে মীম ক্লান্ত।এদিকে মীমের বাবা রেগে আগুন।মীমের পরিবারের হাতে পায়ে ধরে আরো দুই বছর পর মীমকে নিজের করেই ফেলে কাওসার।কিন্তু মীমের বাবা কাওসারের উপর অসন্তুষ্ট নিয়ে বিয়ে দিয়েছিলেন মেয়েকে।

.  ২০২০ সাল। অন্য মেয়ের পিকে লাভ রিয়েক্ট দেওয়ার অপরাধে সপ্তম শ্রেণীতে পড়া রাহা ব্রেকাপ করে নেয় তার প্রথম বফ রাহির সাথে।স্কুল জীবন পার হতেই সমাপ্তি ঘটে এক সম্পর্কের।এখন রাহার মন খারাপ হলে ফেইসবুকে তাকে গান শুনায় সিয়াম। কবিতা লিখে রাহার জন্য। তার কাছে এখন সিয়ামই পারফেক্ট।এক বছর যেতে না যেতেই সিয়ামের ব্যবহারে পরিবর্তন।অবহেলা, চাহিদা জন্মনেয় সিয়ামের কাছে। বাহানা খুজে দূরে সরে যাওয়ার।সবকিছু ভুলে গিয়ে রাহা সত্যিকারের প্রেমিক এর জন্য অপেক্ষা করতে থাকে ।সে মনে প্রাণে বিশ্বাস করে রাইট কোনো একজন একদিন তার জীবনে আসবে।আবার নতুন করে সে জীবন সাজাবে।(হয়তো কোনো দিন কেউ আসবে নতুন দিনের সূচনার জন্য)

.  ২০৪০ সাল।নিহা তার মা মনির সাথে শপিং করতে গেছে।হঠাৎ শপিং মলে একটা ছেলেকে দেখে রাগে ফুসলে যায় নিহা।মা তাকে জিজ্ঞেস করললেন নিহা, কি ব্যপার?এই ছেলেটা কে তুমি চিনো নাকি?নিহা বলল, মা, এতো আমার বফ ছিলো। বাজে একটা।আমাকে তার কথায় চালাইতে চাইছিলো। তাই ব্রেকাপ হয়ে গেছে।"ইটস ওকে বেবী" বলে সান্ত্বনা দিলেন নেহার মা।

.  ২০৬০ সাল।একদিন বিকেল বেলা রানা তার বাবাকে বলল, আজ তো ফ্রাইডে বাবা,বোর লাগতেছে চলো, একটা বার গিয়ে হ্যন্গ আউট করে আসি।রাস্তায় দেখা হলো তার সুজের সাথে।আরে,সুজ হাই,হোয়াটসঅ্যাপ।রানার বাবা বললেন কে?রে, মেয়েটা? রানা বলল, ওহ, সরি বাবা।আমি আর সুজ তিন মাস লিভ টুগেদারে ছিলাম।সুজ, উনি আমার বাবা।"ওহ,হাই আন্কেল, হাওয়ার ইউ" সুজ, আমরা বার যাচ্ছি। তুমি চলোনা আমাদের সাথে।সুজ বলল, উপশহরে একটা বার নিউ হইছে চলেন,একসাথে চেক ইন করে আসি"।ওকে,লেট্স গো।🙂

আমি ঠিক বুঝতে পারতেছিনা, দিন দিন আমাদের উন্নতি না অবনতি কোনটা হচ্ছে।প্রশ্নটা আপনাদের কাছে তোলা থাকলো।

 

 

বেলা হারানোর গল্প

 

         ২০১২ সালের দিকে।দেশ মোটামুটি ডিজিটাল হতে চলছে ।তখন আমি ক্লাস সিক্স পড়ি। আমাদের পাশের গ্রামের এক মেয়ে রাত্রে তার ভালোবাসার মানুষের সাথে পালিয়ে যাওয়ার পথে মেয়ের পরিবার তাদেরকে ধরে ফেলে।এরপর ছেলেকে একরুমে বন্দি করে সারারাত রাখা হয়। অন্যদিকে আরেকটি রুমে রাখা হয় মেয়েকে। পরদিন প্রায় পাঁচ ছয় গ্রামের মহিলারা এসেছিল ১৬ বছর বয়সী কিশোরীকে দেখতে। এলাকার মানুষ ছেলেকে অপহরণের মামলায় পাঠিয়ে দেন জেলে। আজ বছর পর আমার মনেহচ্ছে এই দলেদলে মহিলা মেয়েটিকে দেখার জন্য না গেলেও পারতেন।। জানিনা সময় উঠতি বয়সি কিশোরীর ভিতরে কি অনূভুতি কাজ করছিল।প্রায় দুবছর প্রর্যন্ত সে আমাদের এলাকার খারাপ মেয়ের উদাহরণ হিসাবে থেকে যায়।

. ২০১৯ সালে আমি যে বাড়িটাতে ভাড়া থাকতাম। সেখানের অন্য প্লটে একজন অর্ধবুড়ো মহিলা তার ছেলেকে নিয়ে থাকতেন। ছেলে সবেমাত্র পড়া শেষ করে জব করছে।মহিলা প্রায় অসুস্থ থাকেন। একদিন তার অবস্থা একটু খারাপ ছিলো। তখন আমার মা ভাবলেন মহিলা কে দেখতে যাবেন। একাকী ঘরে অসুস্থ অবস্হায় তিনি কি করতেছেন? মহিলাকে দেখতে গিয়ে আমার মার চোখে পড়লো একটা মেয়েকে, যে মহিলাটার সেবা করছে।মা মহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, কে এই মেয়েটা? মহিলার উত্তর ছিলো, আমার ছেলের বন্ধু। মহিলা অসুস্থ হলেই মেয়েটা আসতো, রাত্রে সে বাড়ি ফিরতনা।চিন্তা করুন,,,কতটা খোলাখুলি সম্পর্ক তাদের পরিবারের মধ্যে হলে একটা মেয়ে বিয়ের আগে এসে বফ এর বাড়িতে থাকতে পারে।আচ্ছা,, তাহলে তাদের বিয়ে দিয়ে দিলে কি হতো? আমি এই ঘটনা আর ২০১২ সালের ঘটনার মাঝে কতোটুকু তফাৎ সেটা ভাবতে গেলেই মাথার ব্যথা দরিয়ে ফেলি। যদিও এক বছর পর ছেলে মেয়ে দুজনের বিয়ে হয়ে ছিলো।

.যখন আমি ছোট ছিলাম তখন আমার পাশের গ্রামে ফুফির বাড়ি যাওয়ার পথে একটা বাড়ি ছিলো।এই বাড়ির সাইটে গেলেই আমার মা বলতেন, এই বাড়িতে একজন ভাই আরেকজন ভাইকে সম্পত্তির জের ধরে মেরে ফেলেছে। বাড়িটার রাস্তা দ্রুত পার হইতাম।যেনো পার হইলেই বাঁচি। বাড়িটাকে মুটামুটি আশেপাশের অনেক গ্রামের মানুষ চিনতো।এ বাড়ির বাচ্চাদের সাথে ভয়ে কেউ মিশতো না। একবার আমার বাবা একজন ডাক্তার কে কল দিয়েছিলেন, উনার বাড়ির ঠিকানা আমার বাবা চিনতে পারছিললেনা। তখন ব্যক্তিটি বলেছিলো , " যে ভাই ভাই মেরেছিলো বাড়ির ডান পাশের বাড়িটাই আমার" চিন্তা করুন কতটা ভয়ন্কর ছিলো ব্যাপারটা।

.এই গত এক সপ্তাহ আগের কথা। পরেরদিনের পত্রিকার মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম গতকাল আমার বাসার পাশে মার্ডার হয়েছে। এই বিষয়টা আমাকে এতো বেশী ভাবিয়েছে মানে বাসার পাশে মার্ডার। অথচ কোনো কোলাহল, চিল্লাচিল্লি কোনো কিছুই শুনলাম না।শুধু আমি কেনো আমার পরিবার বা আমাদের বিল্ডিংয়ের কেউই কিছু বলতে পারেনা। পত্রিকার মধ্যেমে জানলাম, বোনের বাসায় থাকতো ভার্সিটি পড়ুয়া ছেলেটা। বোনের ভাষ্যমতে সকালে নামাজ পড়তে বের হয়েছিলো ১০টা নাগাদ তার মৃতদেহ বাসার সামনে পাওয়া গিয়েছে।

.একবার আমি কোথাও যেনো বেড়াতে গিয়েছিলাম একদিনের জন্য। পরদিন বাড়িতে এসে আমি শুনেছি, আমার অত্যন্ত আদরের ছোট ভাই আমাকে একদিন দেখতে না পেয়ে কান্না করতে করতে বন্যা ভাসিয়ে দিয়েছে। আজ চার, পাঁচ বছরের ব্যবধানে আমার ভাইটা পাবজি, ফ্রি ফায়ার নামক গেইমে নিজেকে এতোটাই ব্যস্ত রাখে আমি তিনদিনের জন্য ঘরছাড়া হলেও সে হয়তো বুঝতেই পারবেনা।

৬।১১-১২ বছর বয়সে গ্রামে কারো বিয়ে হলে পুরো গ্রাম আন্দদে মেতে ওঠতো। প্রতিটা ঘর থেকে একজন হলেও বরযাত্রী হিসাবে যেতো। কিন্তু এই গত বছরের কথা, সন্ধ্যার পর বারান্দায় হাওয়া খেতে বের হয়েছি, তখন লক্ষ্য করলাম পুরো বিল্ডিংটা লাইটিং করা। জমকালো এই লাইটিং এর সুবাদে জানতে পারলাম এই বাসায় কারো বিয়ে হচ্ছে।

.ছোটবেলায় বিকেল হলেই আমরা পাশের বাড়িতে দৌড়ে ছুটতাম খেলার জন্য। আমাদের মন কষাকষি হতো। কিন্তু মিলেমিশে থাকতাম। আজকালের মায়েরা সাত বছরের বাচ্চার হাতে ট্যব,আইপ্যাড ধরিয়ে দেন, পাশের বাসার বাচ্চার সাথে না মিশার জন্য।

("আমি মানবতা দেখেছি। আমি মানবতা হারিয়ে যেতে দেখেছি"।তোমরা এগোচ্ছো, এগিয়ে যাও ভাই। আমিই না হয় একটু সেকেলে থেকে গেলাম")

১

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.