দুই পুরুষ (উপন্যাস) পর্ব-১২
দুই পুরুষ
এম, আব্দুল্লাহ আল মামুন
উপন্যাস পর্ব- ১২
এলাে সকাল নটার সময়, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বপণ কচি। এমন সময়ে হঠাৎ বাবা
এসে হাজির। বাবাকে দেখে কচির মনে হলাে এই কিছু দিনেই বাবা বুড়াে হয়ে
গেছে। কচি !
-তুমি এখানে? আমি কতদিন ধরে তােমাকে খুঁজেছি তা জানাে ? এই বলে
বাবা চারদিকে দারিদ্রের দৃশ্য দেখে অবাক হয়ে গেলেন। বললেন তােমার একটু
দয়া মায়া নেই কচি ? তােমার মা মৃত্যুশয্যায়। তিনি আর বেশীদিন বাঁচবেন
না। আমি তােমায় বাড়ি নিয়ে যেতে এসেছি।
কচি বলল, আমি তােমার বাড়িতে গেলে
আমার বাড়ি কে দেখবে ?
-কিন্তু তােমার নিজের মা, তার অসুখে একবার দেখতে
যাওয়া তােমার উচিৎ
-মার কি অসুখ হয়েছে ?
-হজম হয় না, ঘুম হয় না, আর বেশি
দিন বােধ হয় বাঁচবেও না। যদি শেষ দেখা দেখতে চাও তাে এখনই একবার চলাে।
-তুমি ডাক্তার দেখাচ্ছাে তাে ? ডাক্তার তাে দেখছেই। অসুখটা তােমার জন্যই।
-আমার জন্য কেন ?
-তােমার জন্য না তাে কি ? তুমি না বলে কয়ে আমাদের ছেড়ে
চলে এলে, মনের উপর কতখানি চাপ পরেছে বলাে তাে? তুমিই তাে একমাত্র সন্তান।
তুমি চলে গেলে কষ্ট হয় না আমাদের ?
-আমি যখন মেয়ে হয়ে জন্মেছি তখন একদিন
না একদিন আমাকে পড়ের বাড়িতে বউ হয়ে চলে যেতে হতােই, তখন ?
- কিন্তু এই
কি আমার মতাে একজন ডি সির মেয়ের যােগ্য শ্বশুর বাড়ি ? আমি কি তােমাকে এই
রকম একজন লােফারের সঙ্গে বিয়ে দিতাম ? তােমাকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ারের সংগে
বিয়ে দিতাম।
-কচি রেগে গেল বলল, তুমি কি আমাদের গালাগাল দিতে এখানে এসেছে?
-আমি তাে তােমাকে কোন গালাগাল দেই নি।
- গালাগাল তুমি আমাকে দাও নি বটে
কিন্তু আমার স্বামীকে গালাগাল দিলেও তাে আমার গায়েই লাগে। মস্টার জাকির
এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দাড়িয়ে কথা বলছিলেন। উত্তেজনায় তিনি থরথর করে
কাঁপছিলেন। এবার একটা খালি চেয়ার দেখে তাতেই বসে পরলেন মস্টার জাকির।
বললেন, তুমি যাকে তােমার স্বামী বলছাে সেকি তােমার মত লেখাপড়া
জানা মেয়ের যােগ্য ? আমি তােমাকে যে লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ করেছি তার কি
এই ফল ?
-আমি তােমাকে আবার বলছি আমার স্বামীকে গালাগালি দিলে সেটা আমার
গায়েই লাগে । তেমন স্বামীর মত স্বামী হলে আমি কিছু বলতাম না। কিন্তু এ যে
একজন অশিক্ষিত মােটর মেকানিক।
-কে শিক্ষিত কে অশিক্ষিত তা বােঝবার মত বয়স
আর শিক্ষা আমার হয়েছে। নইলে নিজের ইচ্ছায় আমি তাকে বিয়ে করতাম না।
-তাহলে
বুঝতে হবে আমার এ বয়সেও হয় নি। এখন মনে হচ্ছে তােমাকে লেখাপড়া শিখিয়ে
আমি শুধু টাকাই নষ্ট করেছি।
- তােমার কি মনে হয় না মনে হয় তা নিয়ে আমার
মাথা ঘামানাের দরকার নেই।
-যাক এ বিষয় তর্ক করে সময় নষ্ট করবাে না। আর
তর্ক করে কোন লাভও নেই, আমি চাই তুমি আমার বাড়িতে ফিরে এসাে। আর
ডিভাের্সের ব্যবস্থা যদি করতে হয় তাহলে তার ব্যবস্থাও আমি করতে পারি।
-বাবা
তুমি ভুলে যাচ্ছ যে আমি একজন এ্যাডভােকেট, ডিভাের্স করবার দরকার হলে আমি
তা নিজেই করতে পারি। কিন্তু তার দরকার হবে না। আমার স্বামী মেকানিক হতে
পারে কিন্তু সে সত্যিকারের মানুষ।
-কি যা তা বলছাে তুমি ?
-হ্যাঁ আমি ঠিকই
বলছি বাবা, অফিসার তাে তােমার কল্যাণে অনেক দেখেছি। তারা সবাই শিক্ষিত
মানুষ আর মােটর মেকানিক হলেই তারা অমানুষ, এ আমি বিশ্বাস করি না। এটা ভুলে
যেও না যে মানুষের পেশা দিয়ে মানুষের বিচার হয় না।
-মিস্টার জাকির বললেন,
এখন বুঝেছি তােমাকে লেখাপড়া করিয়ে আমি সত্যিই ভুল করেছি, এখন আমার
অনুরােধ তুমি তােমার মাকে একবার দেখবে। চলাে।
-তা আগে যদিও যেতাম, কিন্তু
এখন তােমার এই সব কথা শােনবার পর আর যাবাে না। সেখানে গিয়েও মা আমাকে এই
সব কথাই বলবে। তুমি শুধু মাকে গিয়ে এই কথাই বােলাে যে আমার স্বামীর হাতে
তােমার মত টাকা নেই, আমার স্বামী তােমার মত ডি সি নয়। কিন্তু আমার স্বামীর
সংসারে আমি খুব সুখেই আছি, এখানে আমার কোন রকম কষ্ট নেই।
আর
একটু বয়স হলে বুঝবে যে এ সুখ নয়। এ এক রকমের আত্ম- | প্রবঞ্চণা। যৌবনের
নেশা যে দিন কেটে যাবে, সে দিন তােমার এর জন্য অনুতাপ করতে হবে তাও বলে
রাখছি।
-তুমি যে যুক্তিই দাও বাবা আমাকে তুমি আমার সংকল্প থেকে নড়াতে পারবে
না। তােমাদের নকল ভ্ৰদ্ৰতা আমি অনেক দেখেছি। ও সব আমি কিছুই ভুলি নি।
তোমাদের সমাজে যারা মানুষ নামের যােগ্য নয়, তাদের মধ্যেই যে সত্যিকারের
মানুষ খুঁজে পাওয়া যায় তার সন্ধান আমি দেখেছি।
-কিন্তু ধরাে আল্লাহ না
করুক যদি তােমার একটা শক্ত অসুখ হয় তার জন্য ভাল নাসিং হােমে রাখবার
ব্যবস্থা করতে পারবে তােমার স্বামী ?
-কচি বলল, তুমি বােকার মত কথা বলছে,
যারা দিনে তিনশাে টাকা খরচ করতে পারে না তারা বুঝি এই রাজশাহীতে বেঁচে নেই ?
-মিস্টার জাকির এবার দাঁড়িয়ে উঠলেন, তােমার সংগে আর তর্ক করবাে না ।
তুমি আমার সংগে যাবে কিনা তাই বলে দাও ।
-না, বাবা।
- তােমার মা বাবার জন্য কি
একটুও মায়া দয়া হয় না ?
-যে সস্তা মায়া-দয়ার কোন মানে হয় না সেই
সস্তা মায়া দয়া আমার নেই। মনে করে নাও তােমাদের মেয়ে মারা গেছে। তা মনে
করতে পারাে না ?
- কিন্তু একটা কথা মনে রেখে দাও যে, যে ছেলেটি তােমাকে
বিয়ে করেছে সে বিয়ে করেছে আমার টাকার লােভে।
- টাকার লােভে মানে ?
-মানে
আমি মারা গেলে আমার টাকা করি সমস্তই সে পাবে ।
-কচি ঘৃণার চোখে বলল, বাজে
কথা। আমি তা বিশ্বাস করি না, আমরা দুজন দুজনকে ভালবেসে বিয়ে করেছি। বরং
আমিই তাকে বিয়ে করতে বলেছি। তবে সে আমাকে বিয়ে করেছে। তােমার ধারণা ভুল।
-আমি বলে রাখছি একদিন কিন্তু এর জন্য তােমাকে অনুতাপ করতে হবে। তুমি অত আরাম
ছেড়ে এই কষ্টের মধ্যে কাটাচ্ছাে এর জন্য একদিন আমার কাছে গিয়ে আশ্রয়ের
জন্য কেঁদে পড়বে। সে দিনের কথা যেন তােমার মনে থাকে।
- আমি যদি উপােষ করেও
মরি তাহলেও তােমার কাছে আমি হাত পাততেও যাবাে না, এ বিষয়ে তুমি নিশ্চন্ত
থাকতে পারাে।
মিস্টার
জাকির মেয়ের কাছ থেকে এ সব কথা শুনবেন তা কখনই আশা করেন। নি।
- বললেন,
তােমারতাে দেখছি বড় অহংকার, এতাে অহংকার ভালাে নয়।
-এতে তুমি অহংকার
কোথায় দেখতে পেলে বুঝতে পারছি না।
-চিরকাল তােমারও সমান যাবে না, এটা তুমিও
ভুলে যেও না। যাক তােমার সংগে বাজে তর্ক করতে চাই না এখন তুমি তােমার মাকে
একবার দেখতে যাবে কিনা তাই বলাে। তােমাকে দেখলে হয়তাে তােমার মা একটু
সেরে উঠতাে
-আমার সময় নেই আজ, আমাকে এক্ষুণি কোর্টে যেতে হবে, আজকে আমার
একটা জরুরী আপিল কেস আছে।
- তাহলে কি কাল যাবে ?
-কালকের কথা কাল বলতে
পারবাে। তাহলে পরশু ?
- দেখাে বাবা যেদিন তুমি আমার স্বামীকে নিজের জামাই
বলে স্বীকার করবে সেদিন আমি তােমার বাড়ি যাবাে।
- তুমি কি বলতে চাও একজন
লােফার কে আমি আমার জামাই বলে স্বীকার করবাে ! এতাে অধঃপতন আমার হয় নি।
তােমারও তাে দেখছি এখনও অহংকার যায় নি, তুমি কি ভাবছাে তুমি এখনও ডি সি আর
তােমার আন্ডারে আমরা চাকরি করি ! আমরা তােমার চাকরি করি না এটা মনে রেখে
কথা বলবে।
এর পর মিস্টার জাকিরের পক্ষে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকা চলে না। তিনি
তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। এতাে অপমান তিনি নিজের মেয়ের কাছ থেকে
শুনবেন এটা তিনি কক্ষণাে আশা করেন নি।
ভাগ্যের চাকা যে কখন কার দিকে ঘােরে
তা সয়ং আল্লাহ ছাড়া আর কেউ বলতে পারে না। মিস্টার জাকির বাড়িতে এলেন।
স্ত্রী বিছানায় শুয়ে থেকেই জিজ্ঞেস করল, দেখা হল কচির সংগে ? দেখা না
হলেই বােধ হয় ভাল হতাে।
- কেন ? আমায় তােমার মেয়ে অপমান করে তাড়িয়ে
দিলাে।
- তার মানে !
-সে
তােমাকে আর কি বলবাে। জীবনে আমাকে কেউ এমন করে অপমান করে নি। আমি ঠিক
করেছি আর আমি তার মুখ দেখবাে না ।
তুমি আমার অসুখের কথা বলেছিলে ?
-
বলেছিলাম কিন্তু তার উত্তরে সে কি বলল জানাে !
- কি ?
-বলল, যেদিন আমি কচির
স্বামীকে স্বীকার করবাে সেদিন সে আসবে তার আগে নয়। ঐ লােফারটাকে কিনা আমি
জামাই বলে কোন দিন স্বীকার করবাে বলতে চাও?
-তা তাে বটেই সে তাে একটা
লােফারের চেয়েও অধম, মােটরের মিস্ত্রী ছাড়া তাে আর কিছু নয়।
-তুমিই বল
আমি কিছু অন্যায় করেছি ?
-আমি হলেও তাে তাই বলতাম।
-যাক গে কচির কথা ভুলে
যাও, মনে করে নাও সে মরে গেছে- মরে গেছে।
মিসেস জাকিরের মুখে কোন কথা
বেরুলাে না শুধু দু'চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগল।
মিস্টার জাকির
নিজের রুমাল দিয়ে তার চোখ দুটো মুছে নিলেন।
-মিসেস জাকির বলল, কি রকম
অবস্থা দেখলে তার ?
-আরে আল্লাহ সে এমন একটা বাড়িতে আছে বস্তি বাড়ি বললেই
ঠিক হয়। একটা ভাঙ্গা টেবিল আর দু'টি হ্যান্ডেল ভাঙ্গা চেয়ার। না আছে ঘরের
মেঝেতে একটা কার্পেট পাতা, না আছে ফ্যান। বােধ হয় বাড়িতে ইলেক্ট্রিক
লাইনও নেই।
-তাহলে কি করে আছে সে বাড়িতে ? ও তাে আমাদের কাছে এসি ছাড়া
ঘুমােতেই পারতাে না। বাড়িতে চাকর বাকর কিছু আছে ?
-আরে কি যে তুমি বল তার
ঠিক নেই। শুনছে সে একটা লােফার। সে তােমার মেয়েকে অত আরামে রাখতে পারবে ?
-তা সেই ছােক্রাটাকে কেমন দেখলে ?
-সে বাড়িতে থাকলে তাে তাকে দেখতে পাবাে !
সে তাে সকাল ৭ টার মধ্যেই কারখানায় মিস্ত্রীর কাজ করতে বেড়িয়ে যায়।
আর
কচি ?
সে কোর্টে প্র্যাকটিস করে তাে শুনলাম।
- প্র্যাকটিস কি রকম করছে ?
চলবে.................


কোন মন্তব্য নেই