চিঠি আসবে (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
চিঠি আসবে
নাজমুল হক
ছোট গল্প
কবি রিচিতি
নাজমুল হক
ষাটের দশকে নওগাঁ জেলার
রানীনগর উপজেলার ভাদালিয়া গ্রামে জন্ম।
বাবা মরহুম নইম উদ্দিন মৃধা। মা মরহুমা হামিদা বেগম।
অল্প বয়সে বাবা
মৃত্যুবরণ করেন।
অনেক প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে থেকেও
রাজশাহী
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগ
থেকে অনার্সসহ এমএসসি ডিগ্রি অর্জন।
কিছুদিন কলেজে শিক্ষকতার পর ১৯৮৫ সালে।
বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায়
উত্তীর্ণ হয়ে
প্রশাসন ক্যাডারে যােগদান।
ব্যক্তিগত জীবনে তিনি দুই
সন্তানের জনক।
স্ত্রী তারা চৌধুরী।
ছাত্র জীবনে সংবাদপত্রের সঙ্গে জড়িত
ছিলেন।
সুযােগ পেলেই নাটক,
কবিতা, প্রবন্ধ এবং গান রচনা করেন।
একজন সঙ্গীত
শিল্পী হিসেবেও
তার পরিচিতি আছে সংশ্লিষ্ট মহলে।
ছােটগল্পে বিশেষ অবদানের
জন্য ১৯৯৯ সালে
‘ফেয়ার এন্ড লাভলী’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন।
চিঠি আসবে
আজ ছুটির চিঠি আসবে। অকারণে ফুরফুরে মনে হয় নিজেকে। দু'হাতে
আঁধার ঠেলে বৃষ্টি ভেজা রাস্তায় বের হয় সুকু। প্রতিদিন ভােরে নির্জন
রাস্তায় হাঁটা সুকুর অভ্যাস। হাঁটতে হাঁটতে ভােরের আলাে আঁধারীর ভেতর
ছুটির অদৃশ্য হাসির কাঁচভাঙ্গা শব্দ শােনে সে। বেহালার করুণ সুরের মতাে
ছুটির নিবিড় কণ্ঠের ফিসফিসিয়ে বলা অনেক কথা উতলা করে তােলে তাকে। ছুটি
থাকলে আঁচল উড়িয়ে এখন তার পাশেই হাঁটতাে। ছুটি নেই। সুকু এখন শুধুই একা,
প্রচণ্ড নিঃসঙ্গ।
সকালে হাঁটতে হাঁটতে শহর ছাড়িয়ে গ্রামের এক নির্জন
পুকুরে এসে বসেছে সুকু। চারিদিক নির্জন শুনশান। পুকুরের পাড় ঘিরে সবুজ
বনানী। কাক চোখ নিথর পানির দিকে আনমনে নিষ্পলক চেয়ে থাকে সুকু। মনে মনে
হিসাব করে, প্রথমে হু হু শব্দে ছুটে যাওয়া বাস, তারপর অথৈ জলের স্টিমার
এবং অবশেষে রিক্সা। আরও পরে ছুটির সােনালী পায়ের মৃদু ছোঁয়ার ধন্য মাটির
আঙ্গিনা পার হয়ে ছুটি হয়তাে এখন তার নিজ বিছানায় দ্রিাচ্ছন্ন। অথবা অন্য
কিছু করছে আপন মনে। সুকুর ভাবনা জুড়ে তাই অশান্ত
আকাশ-বাতাস-লতাপাতা-মাঠ-সবুজ বনানী। সব কিছুই আজ ম্লান, দুঃখ জাগানিয়া ।
ছুটি চলে গেছে দূরে কিন্তু ছুটির কি মনে আছে, বহুদূরে এক অখ্যাত গাঁয়ের
নির্জন পাথর বাঁধানাে পুকুর ঘাটে সূর্য উঠার অনেক আগে কেন এক অস্থির যুবক
কালাে পানিতে তার নিজের প্রতিচ্ছবি খুঁজে ফিরছে। কেন তার আকাশ ভরা বৈশাখী
মেঘ। বিষন্ন প্রকৃতির ভেতর আগুনের মতাে পুড়ছে কেন তার সমস্ত সত্তা। হলুদ
পাতার মতাে বিবর্ণ মন জুড়ে কেন গােধূলি বিকেল। দীর্ঘরাত্রী ভর কেন রাত
জাগা পাখিদের কলরব শুনে শুনে ক্লান্ত ।
বাঁধানাে
সিঁড়ি থেকে উঠে দাঁড়ায় সুকু। পানি থেকে ধাপে ধাপে সিঁড়ি উঠে গিয়েছে
উপরের দিকে। অনিচ্ছাকে পরাজিত করে আলতাে করে পা রাখে উপরের ধাপে। আবার থমকে
দাঁড়ায় এবং সিঁড়ির উপর উদাস দৃষ্টি ফেলে অতীতের পাতা উল্টায় এইতাে
সেদিনও ছুটি তার সংগে এখানে বেড়াতে এসেছিল। নীল শাড়িতে জড়ানাে ছুটি
প্রজাপতির মতাে নেচে নেচে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে এসেছিল । সুকুর বাম হাত
বুকে চেপে ধরে পুকুরের পানির দিকে এগিয়ে গিয়েছিল ছুটি । হাঁটু পানিতে পা
ডুবিয়ে আবার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল তার দিকে। আজও সে পরশ রােমাঞ্চিত করে
সুকুর মন।
নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকে সুকু। চোখ বুজে আনমনে হাসে। ক্লান্ত
চোখের দৃষ্টি ছুঁড়ে দেয় পুকুরের পশ্চিম তীরে । বৃষ্টি ভেজা সবুজ গাছে
কুয়াশা মাখা ভােরের আমেজ। কতগুলাে শিশুগাছ, জলপাই গাছ। জড়াজড়ি করা অনেক
সবুজ লতাপাতা, এক সাড়ি লম্বা তরুণী জিগা গাছ এবং তার পাশেই নিঝুম
দাঁড়িয়ে আছে ঘন সবুজ কায়ার যুবতী কদম গাছ! যেন কাঁদছে। কোথাও কোনাে ফুল
নেই। অথচ এইতাে সেদিন ছুটি কদম ফুল দেখে উচ্ছল হয়ে উঠেছিল। খোঁপায় গুঁজে
ছিল একটি এবং আমার হাতে তুলে দিয়েছিল একটি কদম ফুল। আজ ছুটি নেই। তাই কি
কদম ফুলের প্রয়ােজনও শেষ? ছুটি ফিরে এলে আবার কি ফুলে ফুলে ছেয়ে যাবে কদম
গাছের নিস্তান শাখাগুলাে?
পশ্চিম আকাশে অনেক আগে থেকে মেঘ ছিল। কখন বৃষ্টি
আরম্ভ হয়েছে। বুঝতে পারেনি সুকু। একফোটা শীতল বৃষ্টি সুকুর ডান চোখের
পাতায় আছড়ে পড়ে। নিস্তব্ধ পুকুরের কালাে পানিতে বৃষ্টির ঝুপঝাপ শব্দ
শােনে সুকু। তাইতাে বৃষ্টিতে প্রায় ভিজে গিয়েছে সে। ছুটির দীর্ঘ নিরবতা
তার প্রতিদিনের পৃথিবীর বাস্তবতা আড়াল করে দিয়েছে। খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে
কদম গাছের ছাতার নিচে এসে দাঁড়ায় সুকু। এক অপূর্ব উদাসীনতা গ্রাস করে
তাকে মূহর্তেই। পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় তার অনুভূতি।
আজ ছুটি তার
চেতনায় খুব বেশি আঘাত করছে, কারণ তার চিঠি আসবে আজ। ছুটির দেওয়া হিসেব
মতাে আজই ডাক পিয়ন বয়ে নিয়ে আসবে অপূর্ব সে সম্পদ। সাদা রাজহাঁসের মতাে
আনন্দ হয়ে উড়ে আসবে চিঠিগুলাে। অস্থির হয়ে খাম ছিড়ে ফেলবে সুকু।
নিঃশ্বাস বন্ধ করে, ঝটপট বের করে আনবে এক টুকরাে সুখ, একটি সােনালী
আকাক্সক্ষা। উত্তেজনায় থর থর কাপবে হাত। অবশ হয়ে যাবে দেহ। চঞ্চল দৃষ্টি
বুলিয়ে যাবে আকাক্ষার মসৃণ গায়ে। হাজার বার পড়বে সেখানটায়, যেখানে লেখা
থাকবে ভালােবাসি... ভালােবাসি... ভালােবাসি।
চিঠি পড়ে তার শুধুই মনে
হবে—পৃথিবী লাল নয়, নীল নয়, সবুজ নয়, সাদা নয়,
সেখানে মাটি নেই, পানি নেই, বৃক্ষ নেই, পাহাড়ি নেই... শুধু আছে ছুটি...
ছুটি... ছুটি...
উত্তেজনায় ছটফট করে সুকু। এখনও ঝুপঝুপ বৃষ্টির শব্দ
চারপাশে। ফোটা ফোঁটা পানি সুকুর মাথা, হাত, চোখ সব ভিজিয়ে দিচ্ছে।
মনােযােগ দেয়ার সময় নেই তার। নিজেকে নিয়ে আরও গভীর ভাবনায় ডুবে যায়
সুকুর মন। বুধ, মঙ্গল, বৃহস্পতি, পৃথিবী, আজ মহাবিশ্বের কোনাে গ্রহে
দাঁড়িয়ে আছে সে, সেটি বুঝতে পারে না সুকু। আসলে ছুটি নেই, তাই তার ভাবনার
কোনাে সীমানা নেই। তার অস্তিত্বের মূল সূত্র ছুটি। তার জীবনের মূল বিন্দু
ছুটি। এতে আর সন্দেহ নেই সুকুর।
দীর্ঘদিনের পরিচয় ছুটির সঙ্গে। ভালােবাসা
মান-অভিমানের পাল্লা খুব একটা হালকা নয় তাদের। কয়েক দিন আগে শুধুমাত্র
তিন দিনের জন্য তার গ্রামের বাড়িতে গেল সে। আজও ফিরে এলাে না। ছুটির দীর্ঘ
অনুপস্থিতি সুকুকে অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত করেছে। যাবার বেলা ছুটি বলে
গেল, এ দেহ এবং মন সবই শুধু তার । প্রতিদিন দিন পর পর সে চিঠি লিখবে।
প্রতিদিন ঠিক রাত দশটায় সে সুকুর কথা মনে করবে, সুকু যেন সে সময় চোখ বন্ধ
করে ছুটিকে ভাবে।
এরপর বঙ্গোপসাগরের সব পানি সুখ হয়ে যায়...। সে দিন
থেকে সুকুর আকাশে আর কোনাে চাদ উঠে না, তারা জ্বলে না। দিন রাত শুধু অবিরাম
জ্বলে থাকে ছুটির মুখ ।...এ দেহ মন সবি তার... ছুটির এ কথাগুলাে যেন সােনা
দিয়ে বাধা। তারপরই নিজেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়েছে সুকুর। সুখের এক
নতুন আঘাতে পুরাতন পৃথিবী ভেঙে তছনছ হয়ে গেল তার । অন্য এক স্বপ্নের বিশাল
পৃথিবীর হিরন্ময়ী দুয়ার খুলে গেল। আকাশটা ফুলে ফুলে ছেয়ে গেল । সবুজ
পাতায় ছেয়ে গেল ধূ ধূ বালুচর। কোকিলের কণ্ঠে ভরে গেল বনানী । নদীরা মুখর
হলাে কুলুকুলু রবে । দূরে ডানা মেলে চিলেরা শুধুই উড়লাে সারাদিন-সারারাত।
পৃথিবীতে নতুন করে রচিত হলাে সুখের সংজ্ঞা।
সুকুর ভাবনার রাজ্য আরও বিস্তৃত
হয়। মনে পড়ে কতদিন নির্জনে পাশাপাশি হেঁটেছে তারা। কখনও দিগন্ত জোড়া
মেঠোপথে, কখনও আলােছায়া ভরা স্নিগ্ধ বাগানে, কখনও সূর্য ওঠার আগে
ইউক্যালিপটাস ঘেরা নির্জন হেরিংবােন রাস্তা ধরে । উকু আবার পুকুরের কালাে
পানির দিকে চায়। বৃষ্টি তার অজান্তেই থেমে গিয়েছে অনেক আগে। তার পতনের
প্যান্ট-গেঞ্জি ভেজা । শীতল বাতাসে শিহরণ জাগে।
কিছুমাত্র অপেক্ষা না করে
লম্বা পা ফেলে সামনে এগিয়ে যায় সে। অনেকটা পথ পেড়িয়ে এক সময় সামনে
তাকায় সুকু। ডান দিকে তালাবদ্ধ বালিকা মাদ্রাসা ভবন নিপ শুয়ে আছে। রাস্তার দু'পাশে বৃষ্টিভেজা পাটক্ষেত এবং বাঁশঝাড়
পেড়িয়ে এগিয়ে যায় সে। সারারাত বৃষ্টি হয়েছে। রাস্তার মাঝামাঝি দুটি
জোড়া কালভার্ট দিয়ে বৃষ্টির পানি তােলপাড় করে নেমে যাচ্ছে। কালভার্টের
উপরে রেলিং দিয়ে নিরাপত্তা বেস্টনি দেওয়া হয়েছে। থমকে দাঁড়ায় সুকু।
স্মৃতির জগৎ নিঃশেষে লুটোপুটি খায় এখানে। পা অবশ হয়ে রুদ্ধ হয়ে যায়
চলার গতি। সরাসরি বিমর্ষ চোখের দৃষ্টি যেয়ে থেমে যায় বাম পাশের একটি
নিঃসঙ্গ-নির্বাক দাঁড়িয়ে থাকা ইউক্যালিপটাস গাছের শরীরে। ভেজা দৃষ্টিতে
অনেকক্ষণ সেদিকে চেয়ে থাকে সুকু। কয়েক দিন আগে তারা দু'জনে এখানে বেড়াতে
এসেছিল। ছুটির সেদিনের মুগ্ধ হাতের ছোঁয়া এখনও লেগে আছে সেই ইউক্যালিপটাস
গাছের শরীরে। মনের ভেতর প্রচণ্ড ঝড়ে শাখা-প্রশাখা ভাঙে হৃদয়ের। বিধ্বস্ত
সুকু অবাক হয়ে দেখে তার ডান হাত পরম যত্নে পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে ছুটির
ছুঁয়ে দেওয়া ইউক্যালিপটাস গাছের শরীর । ছুটি বলেছিল, 'সুকু আমি যখন
থাকবাে না তুমি এখানে এসাে, এই ইউক্যালিপটাসের ভেতর আমাকে পাবে।
মাথার উপর
কর্কশ সুরে কাক ডাকে। সুকু নিজেকে গুটিয়ে নেয়। বিশ্বাসে বুক বাধে। আজ
ছুটির চিঠি আসবে। পূব আকাশে সূর্য ঝলমল করছে। অনেকটা মাথার উপর উঠে এসেছে
সূর্য। বাসায় ফেরার তাগিদ অনুভব করে সুকু।
শূন্য বাসার নির্জন উঠোন কোনাে
আকর্ষণীয় স্থান নয় সুকুর । হয়তাে এতক্ষণে বাবুর্চি নাস্তার টেবিল
প্রস্তুত করেছে তার জন্য। তবু ইচ্ছে হয় না তার বাসায় ফিরতে । কি হবে
অনর্থক বাসায় ফিরে । তবুও ফিরতে হয়। ফুল গাছের টবগুলাে তার জন্য অপেক্ষা
করছে। সেগুলােতে পানি দেওয়া প্রয়ােজন। সেভ করা, বেয়ারাকে বাজারে
পাঠানাে, গােসল করা এবং অফিসে যাওয়া-অনিচ্ছা সত্ত্বেও সবই করতে হবে তাকে।
এখন প্রতিটি সকাল আর নতুন কোনাে সুখ বয়ে আনে না, প্রতিটি দুপুর ছুটির সঙ্গ
প্রত্যাশায় অধীর অপেক্ষায় কাটে না, ছুটির কল্পনায় বিভাের প্রতিটি রাত
আর আবেশ ছড়ায় না মনের গভীরে । তাই সুকুর জীবন আজ ছেড়া কাগজের মতাে মলিন।
গভীর রাত। ঘুম নেই সুকুর চোখে। বাইরে মেঘলা দিনের জ্যোৎস্না এবং আলাে
আঁধারীর খেলা। বেলকুনিতে দাঁড়ায় সুকু। দূরের অসংখ্য তারা গােনার চেষ্টা
করে সে এবং আনমনা হয়ে ভাবে, ছুটি এখন কোথায়?' সে কি তারই মতাে। নিঘুম?
নাকি আঁধারের ওপারে সে চিরদিনের মতাে হারিয়ে গেল! ছুটি তার জীবন এমন করে
দিল কেন? এখন তার হৃদয় আগুনের মতাে শুধুই পুড়ছে। অথচ ছুটির চোখে ছিল
ভালােবাসার ঝিলিক। এক প্রত্যয়ী নারীর ভালােবাসার শাশ্বত রূপ দেখেছিল সে
ছুটির মধ্যে। কিন্তু ছুটি কথা রাখেনি । নিঃসঙ্গতা কাটেনি তার। আজ - ছুটির
চিঠি আসেনি।




কোন মন্তব্য নেই