ভাষা সৈনিক (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
গায়ে কখনও ছেড়া কখনও আধা পুরনাে পাঞ্জাবি । শীত
আসে, বসন্ত আসে, ঋতু পরিবর্তন হয় কিন্তু লােকটির কোনাে পরিবর্তন নেই।
বসন্তের আকাশ জুরে বিরহের বাঁশি বাজে প্রতিদিন। কৃষ্ণচূড়ারা ক্রমেই লাল
হয় । দীর্ঘশ্বাসের মতাে বাতাস বুকের ভেতর আলােড়ন তােলে। এর ভেতর লােকটির
বেমানান হাঁটা মানুষকে বিরক্ত করে। কেউ কেউ নিঃশব্দে গালি দেয় তাকে।
তাইতাে এমন সুন্দর পরিবেশে এমন বেমানান অভদ্র মানুষ কেইবা দেখতে চায় ।
রতনদীঘি
কলেজের পেছনে নির্জন বাঁশ ঝড়ের পাশেই তার জীর্ণ কুঁড়ে ঘর । সাত পুরুষে
কেউ নেই। তার একমাত্র সন্তান মুক্তিযুদ্ধ থেকে আর ফিরে আসেনি। এক সময় নাকি
লােকটি এ কলেজের ছােট একটা কর্মচারি ছিল। এখন কর্মক্ষমতা নেই। কখনও খেয়ে,
কখনও না খেয়ে তার দিন কাটে।
আজ
সকাল থেকেই কলেজের সবার ব্যস্ততা। প্রকাণ্ড মাঠটি রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানাে
হয়েছে। একপাশে দর্শনীয় মঞ্চ নির্মিত হয়েছে। মস্ত তােরণে প্রধান অতিথির
জন্য স্বাগতম বার্তা শােভা পাচ্ছে। মাননীয় প্রধান অতিথি এ অঞ্চলের গর্ব।
তার সঙ্গে একটা ছবি অনুষ্ঠান চলাকালে কিভাবে তােলা যায় এবং সে ছবি দেখিয়ে
কিভাবে নিজের সুবিধা আদায় করা যায়, নেতা কর্মীরা এখন সে চিন্তায়
বিভাের।
মিঠুর মন আজ
পালকের মতাে ফুরফুরে। কারণ, আজ দীর্ঘ সময় ধরে সে লতাকে পাশে পাবে। সাদা
পায়জামা পাঞ্জাবি পরে পূর্ণাঙ্গ বাঙ্গালী হবার চেষ্টা করেছে সে আজ। লতার
আসবার সময় অনেক আগেই পেরিয়ে গেছে কিন্তু এখনও পাত্তা নেই। মিঠু লতার
আসবার পথে আবারও তাকায় । ঠিক তখনই। বৃদ্ধ শরীফ আলীর কদাকার দেহ তার
দৃষ্টিগােচর হয়। লাঠিতে ভর দিয়ে ব্যাঙের মতাে এগিয়ে যাচ্ছে। মিঠু বিরক্ত
হয়, লােকটির কি আক্কেল নেই; এমন একটি দিনের আনন্দ মাটি করে দিতে তার
মঞ্চের আশেপাশে আসার কি প্রয়ােজন ছিল। প্রধান অতিথি যদি এ সময় হঠাৎ এসেই
পড়েন, তাহলে অনুষ্ঠানটিই মাঠে মারা যাবে। একরাশ বিরক্তি নিয়ে অন্যদিকে
চোখ ফেরায় মিঠু।
উদ্বোধনের
পরেই বিচিত্রানুষ্ঠান। ছাত্রছাত্রীরা ইতােমধ্যেই কলেজ প্রাঙ্গণে উপস্থিত
হয়েছে। সমস্ত মাঠ দর্শকে ভরে গেছে প্রায়। মাইকে মিষ্টি কণ্ঠে অনুষ্ঠানের
বিস্তারিত বিবরণ মাঝে মাঝে ঘােষণা দেয়া হচ্ছে। আজ ২১শে ফেব্রুয়ারি ।
রতনদীঘি কলেজ প্রাঙ্গণে নবনির্মিত শহীদ মিনারের শুভ উদ্বোধনের জন্য আজকের এ
অনুষ্ঠান।
হােসেন আলী
চৌধুরী শহীদ মিনারের উদ্বোধন ঘােষণা করবেন। তিনি এলাকার সংসদ সদস্য এবং
মন্ত্রী। রাজধানী থেকে হেলিকপ্টার যােগে সরাসরি তিনি কলেজ প্রাঙ্গণে অবতরণ
করবেন। তার একটুও যেন কষ্ট না হয় সে বিষয়ে সবাই সতর্ক।
রােদের
ঔজ্জ্বলতা ক্রমেই ম্লান হয়ে এসেছে। কলেজ প্রাঙ্গণে কৃষ্ণচূড়া গাছে লালের
প্রচণ্ড সমারােহ। প্রকৃতির বিষন্নতা বসন্তের আকাশে লুকোচুরি খেলায়
ব্যস্ত।
মাননীয় প্রধান
অতিথির হেলিকপ্টারটি ঐ মেঘের মধ্যে দিয়েই উড়ে এলাে ঠিক তখনই। সবার মধ্যে
এক প্রচণ্ড চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে হােসেন আলী চৌধুরী প্রায় মাটিতে পা না
ফেলেই মঞ্চে এগিয়ে গেলেন।
মিঠু
আবার লক্ষ্য করে, বৃদ্ধ শরীফ আলীকে। বিশ্রী একটা পাঞ্জাবি গায়ে এক হাতে
লাঠিতে ভর দিয়ে বৃদ্ধ শরীরের শেষ শক্তি ব্যয় করে মঞ্চের দিকে এগিয়ে
যাচ্ছে । শরীফ আলীর ডান হাতের অর্ধেকটা নেই। হয়তাে কোনাে দুর্ঘটনায় কেটে
ফেলতে হয়েছে। বিতৃষ্ণায় মিঠু চোখ ফেরায়। এই লােকটি আজকের এমন
জাঁকজমকপূর্ণ আয়ােজনটিই ব্যর্থ করে দিল । শরীফ আলী ততক্ষণে মঞ্চের পাশের
প্রথম সারির আসনগুলাের দিকে এগিয়ে যায় । আশ্চর্য হয় মিঠু, পুলিশগুলাে
লক্ষ্যই করে না তাকে। শরীফ আলী সবার অজান্তেই একটি আসন দখল করে বসে পড়ে ।
একটা
মিষ্টি রজনীগন্ধার সুবাস মিঠুকে আচ্ছন্ন করে। কৃষ্ণচূড়ার রক্ত রঙকে আরও
রক্তিম করে ঝংকৃত হয় একটি মধুর কণ্ঠ। সর্বাঙ্গ অবশ করে দেয় একটি পরিচিত
পরশ। মিঠু পেছন ফিরে চায় অবাক চোখে । লতাকে দেখে । লতা হাত জোড় করে ক্ষমা
প্রার্থনা করে বিলম্বের জন্য। মিঠুর অভিমান নিমিষেই মুছে যায় । মনটা আবার
সজীব হয়ে ওঠে। লতা এসেছে অবশেষে। লতা জানায়, তার বাবা অনুষ্ঠানে এসেছেন।
একই সংগে আসতে হয়েছে বলে বিলম্ব হয়েছে তার। ডান হাত তুলে দূরে মঞ্চের
পাশে দাড়ানাে তার বাবাকে দেখায় লতা।
উদ্বোধনী
অনুষ্ঠান আরম্ভ হয়ে গিয়াছে। ওদিকটায় তিল ধারণের ঠাই নেই। ওখানে কোনাে
আসন ফাকা নেই। লতার মুখের দিকে চায় মিঠু। অপমানিত বােধ করে। নিজেকে অপরাধী
মনে হয় ।
লতার বাবা
স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি হােসেন আলী চৌধুরীর
নিকট পরাজিত হয়ে কোণঠাসা হয়ে আছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধে তিনি এবং আজকের
প্রধান অতিথি হােসেন আলী চৌধুরী একই সংগে রাজাকার বাহিনীতে যােগ দেন।
দুজনেই আর্মিদের খাদ্য সরবরাহ করেন। নারী নির্যাতনের ইতিহাসও কারাে অজানা
নয়। তার পরের ইতিহাস খুবই সহজ। গত তেইশ চব্বিশ বছরে তাদের অত্যাচারের কথা
ভুলতে ভেতাে বাঙ্গালীর কোনাে অসুবিধাই হয়নি। আজ সমাজের শ্রেষ্ঠ আসনটি
তাদের জন্য নির্ধারিত হয়ে আছে।
কিন্তু এখন কি করা যায়। তার বাবা তখনও দাড়িয়ে আছেন। কেউ তাকে বসার আসন এগিয়ে দেয়নি। ভিড়ের কারণে কেউ তাকে দেখতে পাননি।
মিঠু
নিজ আসন ছেড়ে লাফিয়ে উঠে। স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব তারও ছিল কিন্তু লতার
আসার বিলম্বের কারণে তার মন এতােক্ষণ বিক্ষিপ্ত হয়েছিল। এখন দায়িত্ববােধ
মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। মুহূর্তেই তার লক্ষ্য হয়ে উঠে বৃদ্ধ শরীফ আলী। সে
লম্বা পা ফেলে এগিয়ে যায় শরীফ আলীর দিকে । শরীফ আলীর ডান হাত কাটা থাকায়
বা হাতটি ধরে এক হ্যাঁচকা টান দিয়ে টেনে তুলে তাকে মিঠু। চোখ রাঙিয়ে
ধমকের সুরে বলে,
এই
বে-আক্কেল বুড়াে। চোখে দেখ না, লােকজন দাঁড়িয়ে আছে। আর তুমি রাজা বাদশার
মতাে বসে আছে। কে বলেছে তােমাকে এখানে আসতে? জান না এ জায়গা সবার জন্য
নয়।
বৃদ্ধ শরীফ আলী
দুর্বল শরীর সামাল দিতে পারে না। প্রায় ছিটকে পড়ে যায় আসন থেকে। তারপর
লাঠিটি খামচে ধরে দাঁড়াতে চেষ্টা করে কিন্তু আবার হুড়মুড় করে পড়ে যায়
নিচে। চারদিকের দর্শক আর ছাত্রছাত্রীরা মিঠুর এ বীরত্বে অনুপ্রাণিত হয়।
অনেকেই হাত তালি দেয়। শরীফ আলী শীর্ণ পায়ে ভর করে সেই পুরাতন ভঙ্গিতে
লাঠিতে ভর দিয়ে হেঁটে মাঠের এক ধারে এসে ঘাসের উপর বসে পড়ে। উৎসবের
উদ্দামতায় তার চোখের উদাস দৃষ্টি কেউ দেখতে পায় না। শরীফ আলী সূদুর
অতীতের স্মৃতি রােমন্থনের চেষ্টা করে তখন। কিন্তু সব কিছুই ধোয়াটে মনে হয়
তার। মনে হয় কি প্রয়ােজন ছিল ভাষা আন্দোলনের, কি প্রয়ােজন ছিল
মুক্তিযুদ্ধের
রাত্রীতে
বাড়ি ফিরে অবাক হয় মিঠু। অতিথি এসেছে বুঝতে কষ্ট হয় না। বিদেশ থেকে তার
নানা দীর্ঘদিন পর ফিরে এসেছেন। নানার পাশে বসে গভীর রাত পর্যন্ত গল্প করে
মিঠু। শহীদ মিনারের উদ্বোধনের বিষয়টি নানাকে জানাতে বিলম্ব হয় না তার।
মিঠু লক্ষ্য করে হঠাৎ করেই উদাস হয়ে যায় তার নানার দৃষ্টি । মনে হয়
অতীতের কোনাে গভীর জঙ্গলে অথবা কোনাে এক নির্জন গিরিখাদে পড়ে রাস্তা
হারিয়েছেন তিনি। নির্জনতা ভাঙতে মিঠু জিজ্ঞেস করে
কি হয়েছে নানা? চুপ করে আছ কেন?
ভাষা
আন্দোলন? শহীদ মিনার? ক’জনকে মনে রেখেছাে তােমরা। চামচিকারা দেশপ্রেমিক
হয়ে গেল, আর পায়ের নিচে দেশপ্রেম রেখে তােমরা উদ্বোধন করছে শহীদ মিনার?
চারিদিকে রাজাকারের রাজত্ব। শকুনেরা দেশ শাসন করে। শহীদ মিনার উদ্বোধন করে
একজন খুনি। হায়রে দেশপ্রেম!
নানা স্বেচ্ছায় বলে চলেন,
আমিও
তাে ভাষা সৈনিক ছিলাম। কিন্তু কে মনে রেখেছে আমাকে ? নিজের স্বার্থে আজ
রাজাকারের পা চাটছে সবাই। এখনও সময় আছে। শয়তানদের হাত থেকে দেশকে
বাঁচাও।
মিঠু অবাক হয়। দ্রুত কণ্ঠে বলে,
তুমি ভাষাসৈনিক ছিলে? তাহলে আজম ব্যাপারি, হােসেন আলী?
নানা
যেন কিছুই শুনতে পাচ্ছেন না, ধীর কণ্ঠে বলতে থাকেন, ওরা মূখ, স্বার্থপর,
ওরা শকুন, ওরা খুনি। ভাষার জন্য জীবন দিতে হলাে, রক্ত দিতে হলাে। কিন্তু
আমাদের মনে সেই ভাষার স্থান কোথায়? আমাদের মূর্খ রাজনীতিবিদরা ভাষার মর্ম
বুঝবে কিভাবে?
মিঠু আবারও নানার ধ্যান ভাঙ্গানাের চেষ্টা করে। কণ্ঠে জোর দিয়ে প্রায় চিৎকার করে বলে,
নানা তুমি ভাষা আন্দোলনের গল্প বলাে। আমি জানতে চাই। কেউ তাে আমাদের এসব বলে না।
নানা আবার আরম্ভ করেন...
শুধু
আমি নয়রে। আমার মতাে অনেকেই জীবন তুচ্ছ করেছিল। কেন..., তােমাদের
রতনদীঘির শরীফ আলী আর আমি দুজনেই একই সংগে আন্দোলন করেছি। আমরা বন্ধু ছিলাম
। শরীফ আলী আন্দোলনে তার ডান হাত হারায়। অভাবের জন্য তারপর আর সে কলেজে
ফিরে যেতে পারেনি। ১৯৭১ সালে সে নিজে যুদ্ধে যেতে পারেনি কারণ তার ডান হাত
ছিল না। কিন্তু তার একমাত্র ছেলেকে যুদ্ধে পাঠায় । তার সে সন্তান আর ফিরে
আসেনি। হারে শরীফ আলী কি বেঁচে আছে?
মিঠুর
কণ্ঠরােধ হয়ে আসে। একটা অপরাধবােধ তাকে পীড়া দেয়। মাথার উপর ফ্যানের
একটানা শব্দ মনে হয় প্রধান অতিথির হ্যালিকপ্টারে শব্দের চেয়েও ভয়ঙ্কর।
ভাষা সৈনিক শরীফ আলী আজ শহীদ মিনারের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে শুধুমাত্র একটি
আসন আঁকড়ে ধরার ক্ষমতাও অর্জন করতে পারেনি। নিজের প্রতি অকারণ ঘৃণায়
মিঠুর শরীর রি রি করে উঠে। শুধু ভাবে হায়রে দুঃখিনী ভাষা।




কোন মন্তব্য নেই