সমুদ্রের কান্না (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
ঘরের মধ্যে মােমের মতাে গলে যাওয়া আঁধার ঘন হয়ে আছে। বাইরে ঝমঝম বৃষ্টি।
সন্ধ্যা ছয়টায় কিশােরগঞ্জের মূল থানা সদর থেকে বিচ্ছিন্ন এক সবুজ বনের
মাঝে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা এ ডাক বাংলােয় এসে উঠেছে শহীদ। অল্প কিছুদিন
আগে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর আগমন ঘটেছে এখানে। এখনও সব কিছু ঝকঝকে, তক-
তকে। ফোমের গদি আটা বিছানায় শুয়ে চোখ বন্ধ করে আরাম অনুভব করে সে। দেয়াল
ঘড়িতে রাত চারটে বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। চোখের পাতায় ঘুমের চিহ্নও নেই।
প্রায় রাতই তার এমনই কেটে যায়।
নীলফামারী জেলা সদরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট
শহীদ। কয়েক দিন আগে এ অঞ্চলের দু’জন বিখ্যাত মুক্তিযােদ্ধা খুন হয়েছেন।
এক সময়ের রাজাকার এবং বর্তমানের প্রতাপশালী রাজনীতিবিদ ও শিল্পপতির একজন
পাতিনেতা পুত্রের বিরুদ্ধে খুনের অভিযােগ আনা হয়েছে। পর পর দুটি পুলিশী
তদন্তে না- রাজি দরখাস্ত পড়ায় বিজ্ঞ আদালত থেকে তদন্তের দায়িত্ব আসে
শহীদের উপর। সে জন্যই তাকে থাকতে হবে এখানে দু' একদিন । অপরাধীর পক্ষে
উর্ধমহল হতে তার উপরও চাপ আসছে টেলিফোনে। শহীদের মাঝে-মাঝে ইচ্ছে হয়
স্বাধীনতার শত্রুর প্রতি উর্ধমহলের এ আচরণের প্রতিবাদ করার। বিতৃষ্ণায় মন
বিক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তার। সবাইকে তার বিশ্বাসঘাতক মনে হয়। শুধুমাত্র তাকে
অযথা কষ্ট করতে হচ্ছে এ পরবাসে। অবশ্য হােটেল সােনারগাঁ আর কমলাপুরের
প্লাটফরম তার কাছে একই। একটি নির্জন গৃহকোণ, মসৃণ হাতের কাঁকনের শব্দ, আর
রবীন্দ্র সংগীতের মূর্ধনা তাকে অবশ করে দিলনা এ জীবনে। জীবন তাকে প্রতারণা
করেছে। একাকিত্ব তাই তার জীবনের নিত্য বিলাস ।
জানালার
পাশে উঠে যায় শহীদ। নিথর রাতের বৃষ্টি ধারা ভাের রাতকে মধুর করে তুলেছে।
দূরের জোনাকীর মতাে তার জীবনও কি স্মৃতির নিপ্রাণ আগুনে জ্বলে ছাই হয়ে
যাবে? মনের অজান্তে অতীতের দরজা খুলে যায় শহীদের...
‘প্রীতি’ এখনও তেমনি
আছে তার আকাশ জুড়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই কবিতার মতাে দিনগুলাে ভাঙা বালির
বাঁধের মতাে কত নিঃশব্দে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। প্রীতি ক্রমেই ধূসর হয়ে
গেল, কিন্তু ভােলা তাে গেল না।
শহীদ বেড সাইড টেবিলে রাখা প্যাকেট হতে একটি
সিগারেট হাতে তুলে নেয়। বাহিরের বৃষ্টি আরও ঘন হয়ে এসেছে। সিগারেট ছেড়ে
দিয়েছিল সে। প্রীতির নিষেধের বাধা অতিক্রম করে সিগারেট খাওয়ার সাধ্য
কোথায় তার। এখনতাে সীমাহীন একাকিত্ব। এখন প্রীতি নেই। শুধু সিগারেট আছে।
মনে পড়ে
যেন এইতাে সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় শিক্ষা সফরে তারা
সুন্দরবন গিয়েছিল। হিরণ পয়েন্ট রেস্টহাউসের তিনটি কক্ষে তাদের তিন দিনের
অবস্থান ছিল। ছয়জন ছাত্রীর মধ্যে প্রীতিও ছিল । কাচের মতাে তন্বী দেহ আর
ঝরনার মতাে উচ্ছলতা ছিল প্রীতির আচরণে। গভীর রাতে নিজ নিজ ঘরে ঘুমিয়ে ছিল
সবাই । সংগে নিয়ে আসা কম্বল বালিশ আর মশারিই ছিল তাদের শােবার রাজকীয়
উপকরণ। শহীদ বালিশ এবং মশারি সংগে আনেনি। তার এসব লটবহর, মােটেও সহ্য হয়
না। শুধুমাত্র কম্বলে শুয়ে সুন্দরবনের মশার সংগে মল্লযুদ্ধে অবতীর্ণ এবং
পরাজিত হয়ে ঘুমে ইস্তফা দিয়ে গা-ঝাড়া দিয়ে উঠে বসে শহীদ। স্বরচিত রাজ
শষ্যা অসহ্য মনে হয়। নিঝুম রাত অনন্তকালের মতাে দীর্ঘ হয়ে যায় । চুপি
চুপি দরজা খুলে তিনতলার বেলকুনিতে এসে দাঁড়ায় শহীদ। চারিদিকে নিবিড়
বনাঞ্চল । মাঝে মাঝে বিচিত্র প্রাণীর কলরব। কাছের বঙ্গোপসাগরের বিশাল
ঢেউয়ের ঝরের মতাে শোঁ-শোঁ শব্দ মনকে অস্থির করে তুলেছে। রেস্টহাউসের
চারিদিকের বহু দূর বেষ্টিত কাঁটাতারের বেড়া, সব মিলিয়ে একটা অদ্ভুত
ভালােলাগা শহীদের মন আচ্ছন্ন করে'। অথচ পাশের ঘরেই প্রীতি ঘুমিয়ে আছে...।
তাকে কাছে পাওয়া গেলে নিঘুম রাত প্রাণবন্ত হয়ে উঠতাে।
পায়ের শব্দে চমকে
উঠে শহীদ। এক অনাবিল আনন্দে মন ভরে যায়। প্রীতি পাশে এসে দাঁড়ায়। তার
রাত জাগা চোখ সাক্ষী দেয় সেও ঘুমায়নি ।
তােমার কি চোখে ঘুম নেই? আমাকেও
কি ঘুমাতে দেবে না? তােমার নিঃশ্বাসের শব্দেই বুঝেছি, তুমি জেগে আছ।
আবেগ
জড়ানাে কণ্ঠে একটুও বিরক্ত না হয়ে, প্রীতি ফিসফিসিয়ে কথা বলে ।
আসলে
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের মতাে বিশাল দেহের মশাগুলাে আমাকে ঘর ছাড়ালাে।
কম্বলের বাধন ছিড়ে বেরিয়ে এলাম । ঠিক করেছি সুন্দরী গাছের কিশােরী পাতার
মুখ দেখেই কাটিয়ে দিবাে সারাটি রাত। কিন্তু তােমার চোখে কি আকাশ ভেঙে
পড়েছে; না কি শিয়ালে বাসা বেঁধেছে যে, তােমার চোখেও ঘুম নেই?—উত্তর দেয়
শহীদ।
প্রীতি কোনাে কথা বলে না, শুধু শহীদের বিছানাটা উকি মেরে দেখে আবার
ফিরে আসে। প্রশ্ন করে,
তুমি আমাকে কত জ্বালাবে? এই নির্বোধ মেয়েটার প্রতি
তােমার এতটুকুও কি মায়া থাকতে নেই? শুধু ওই কম্বলটাই বােধ হয় তােমার
আশ্রয়ের একমাত্র সহায়! নিজে কষ্ট করছাে কি আমাকে শায়েস্তা করার জন্য?
তাওতাে আছে। অনেকের তাে ওই ফুটপাথ আর একখণ্ড ইট-ই বিলাসবহুল আশ্রয় । উত্তর
দেয় শহীদ। সাদা ঝক ঝকে দাঁতে নিস্পাপ উজ্জ্বলতা ছড়িয়ে হাসে প্রীতি।
চোখের তারায় একটা গর্বের আলােছায়া খেলা করে। সােজাসুজি শহীদের দিকে চায়।
অসম্ভব মায়ার এক নিবিড় ব্যঞ্জনা সেখানে উত্তাল হয়ে উঠে। কোনাে কথা বলার
প্রয়ােজন বােধ করে না সে। দ্রুত পায়ে প্রস্থান করে। নিজের বিছানা হতে
বালিশ মশারি নিয়ে একটু পরেই ফিরে আসে কোনাে বিলম্ব না করে। পরিপাটি করে
নিঃশব্দ আগ্রহে শহীদের বিছানা প্রস্তুত করে। প্রীতির ফর্সা তন্বী দেহ আবছা
আঁধার ঘরে এক মােহময় পরিবেশ সৃষ্টি করে। শহীদ অবাক হয়ে প্রীতির
ভালােবাসার গভীরতা মাপে। উপলব্ধি করে এক রাজহংসীর মতাে কমনীয় নারীর অসীম
ভালােবাসা তার জীবন ভরিয়ে রেখেছে পরম নির্ভরতায়। এ তার জীবনের চরম সফলতা।
সে ধন্য। প্রীতি আবার পাশে এসে দাঁড়ায়। নিঃশব্দে হাসে। বলে,
জাহাপনা
বাদী আপনার খাট-পালঙ্ক প্রস্তুত করে দিয়েছে। শয়ন সুখ অনুভব করে তাকে
কৃতার্থ করুন। রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা এখন প্রাসাদে প্রবেশের পথে বাধা
পাবেন। অতত্রব মল্লযুদ্ধের এখানেই বিরতি। বিশ্রাম করতে পারেন মহারাজ। হাসতে
হাসতে রাণীর অভিনয় করে প্রীতি।
তারচেয়ে ঐ দূরের শুকতারার দিকে চেয়ে
সমুদ্রের শোঁ-শোঁ সুর শুনে সারাটি রাত এখানে কাটিয়ে দিতেই আমার ভালাে
লাগবে। তুমি শুধু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকবে আমার সামনে। তাহলে রয়েল বেঙ্গল
টাইগাররা মুগ্ধ হয়ে চেয়ে থাকবে তােমার দিকে, আক্রমণ করার সুযােগ পাবে না।
উত্তর দেয় শহীদ।
প্রীতির হৃদয়ে এক অজানা ভালাে লাগার কোকিল ডাকে।
সেতারের মৃদু সুর বাজে বুকের গভীরে। হাত বাড়িয়ে শহীদের দু’হাত টেনে নেয়
নিজ হাতে। পরম আগ্রহে বুকে চেপে ধরে। অনুভব করে আরেক হৃদয়ের অবিরাম
অনুরণন। তারপর নিবিড় ভালােবাসায় হাত দুটো স্পর্শ করে তার পালকের মতাে নরম
অধরে । প্রীতি খুব
আস্তে ছেড়ে দেয় শহীদের দুটি হাত এবং নিজের পােষাকের ভেতর লুকিয়ে রাখা
একটা সােনালি অপূর্ব সুন্দর ঘড়ি শহীদের চোখের সামনে তুলে ধরে।
মংলা
পাের্টে এটি তােমার জন্য কিনেছি। সারাদিন তােমার সঙ্গে ছায়ার মতাে মিশে
থাকতে ইচ্ছে হয় আমার। কিন্তু সে তাে সম্ভব নয়। এই ঘড়ি তােমার দেহে আমার
স্পর্শের মতাে উষ্ণতা ছড়াবে। তুমি শুধু ভাববে আমার ইচ্ছে হয় আমার সবকিছুই
আমি তােমাকে দিয়ে দিই। ইচ্ছে হলে তুমি আমাকে নিয়ে যা খুশি করতে পার,
যেমন খুশি ব্যবহার করতে পার। এ দেহ এবং মন সব তােমার। আমার নিজস্ব কিছুই
নেই।
শহীদের বাম হাতে ঘড়িটি পরিয়ে দিতে দিতে গভীর আবেগে কথাগুলাে বলে
প্রীতি। শহীদকে কোনাে কথা বলার সুযােগ না দিয়েই আবার বলতে শুরু করে
প্রীতি।
‘শহীদ তােমাকে আমার ভীষণ প্রয়ােজন। তুমি কখনও আমাকে ছেড়ে চলে যেও
না। আমি শুধু তােমারই জন্য যুগ যুগ অপেক্ষা করবাে।'
দূর হতে আযানের সুর
ভেসে আসে। প্রীতি ফিরে যায় নিজ ঘরে। শহীদ ভালােবাসার পালঙ্কে আশ্রয় নেয়।
কিন্তু ঘুম সূদুরে হারিয়ে যায়। প্রীতির যত্নে সাজানাে বিছানা-বালিশ,
মশারি আর কম্বলে এক অজানা মৌ-মৌ গন্ধ আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। বালিশে
প্রীতির চুলের মিষ্টি সুবাস, বিছানার স্তরে স্তরে প্রীতির মধুর হাতের
স্নিগ্ধ পরশ। এক প্রত্যয়ী আনন্দে ঝিম মেরে থাকে শহীদ।
হঠাৎ দরজায় ঠক ঠক
শব্দ হয়। ডাকবাংলাের চৌকিদার ছােবহান মিয়ার কণ্ঠ শােনা যায়-
স্যার চা
খাবার সময় হয়েছে। নাস্তা দিব কি?
জানালা থেকে দৃষ্টি সরিয়ে দেয়ালে
স্থাপিত ঘড়ির দিকে তাকায় শহীদ। সাতটা বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিট। ব্যস্ত হয়ে
উঠে সে। অর্ধেকটা রাত সে জানালায় দাঁড়িয়ে স্মৃতির প্রদীপ জ্বালিয়ে এখন
বাস্তবে ফিরে এলাে।
অথচ আজ তার অনেক কাজ । ভালাে লাগার কল্পিত প্রাসাদ তার
মুহুর্তেই ভেঙে গেল। বিরক্তিতে বিস্বাদ হয়ে গেল মনটা। মনে মনে ভাবে হায়
অভাগা দেশ। খুনি, ধর্ষণকারী রাজাকার আর দালালদের তুমি এমনিভাবে বুকে আশ্রয়
দিলে। শয়তানদের রক্ষা করার জন্য দেশের কর্ণধারদের এ কেমন কলঙ্কিত বেহায়া
প্রচেষ্টা! মনে মনে আবার ও প্রতিজ্ঞা করে শহীদ, চাকরি থেকে যদি বরখাস্তও
হতে হয় তবুও ভালাে। কারাে চাপের মুখে রাজাকারের বাচ্চাকে কিছুতেই
অন্যায়ভাবে বাঁচতে দেবে না সে।
চা
খেতে খেতে সারাদিনের কাজের একটা ধারাবাহিক পরিকল্পনা করে শহীদ। আসলেই সময়
নেই। দ্রুত কাজ শেষ করতে হবে।
আবারাে দরজায় ঠক ঠক শব্দ। যেন কোনাে পরিচিত
হাতের ছোঁয়া। কাগজে চোখ রেখেই জিজ্ঞাসা করে শহীদ.......
ভাবে, ছােবহান মিয়ার
অযথা সময় নষ্ট করছে সে।
আচ্ছা ছােবহান মিয়া রতনপুর...
কথা শেষ হয় না।
একটা চেনা পায়ের শব্দ। কাঁকনের মৃদু রিনিঝিনি ঝংকার, এবং শাড়ির পরিচিত
একটা খস খস শব্দে চোখ তুলে সামনে চেয়ে চমকে উঠে শহীদ। হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন
দশগুণ বেড়ে কণ্ঠ শুকনাে নদীর মতাে হয়ে যায় তার। চোখের পলকেই মনে হয় সে
মঙ্গল গ্রহের কোনাে এক অজানা নির্বাক প্রাণী, নিজের কোনই অস্তিত্ব নেই।
প্রীতিই কথা বলে প্রথমে,
স্যরি, তােমার অনুমতি ছাড়াই ঘরে চলে এলাম । আমাকে
দেখে খুব অবাক হচ্ছাে তাইনা! চিনতে পারছাে তাে? আমি প্রীতি। মুখের দিকে
ওভাবে তাকিয়ে আছাে কেন?
শহীদ বাস্তবে ফিরে আসে। জিজ্ঞাসা করে,
তুমি এখানে,
এভাবে, তুমি... তুমি! কেমন আছাে এতদিন পর... ভালাে আছাে তাে,..
হ্যা, এখান
থেকে দু’মাইল দূরে আমার শ্বশুর বাড়ি রতনপুর । আমি কিছুদিন এখানেই আছি।
শহীদ, আমি খুব বিপদে। শুধু তুমিই আমাকে উদ্ধার করতে পার । প্রীতির কণ্ঠে
বিনীত অনুরােধ ঝরে পড়ে।
শহীদ নির্বাক হয়ে যায়। মনে পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের
ফেলে আসা দিনের কথাগুলাে। এক কোটিপতি রাজাকারের পুত্রের লােভী হাত ধরে
প্রীতি এদেশের সবুজ মাটি ছেড়ে উড়ে গেল । শহীদ তখন তার জন্য অপেক্ষার
প্রহর গুনছিল । প্রীতি একবার ফিরেও দেখলাে না, এখানকার পাখি কতদিন গান গায়
না, কতদিন পাঁপড়ি মেলেনা ফুলেরা। শরতের আকাশে কতদিন মেঘের ভেলা ভাসে না,
কতদিন প্লাবিত চাদের আলােয় বনের লতাপাতা উজাড় করে দেয় না হৃদয়ের
উত্তাপ। কেমন করে আরেকজনের পায়ের তলার অসীম পৃথিবী নিমিষে উড়ে গেল
প্রীতির চলে যাওয়া। বিমানের পাখায় ভর করে। সেই প্রীতি আজ এখানে এভাবে?
শহীদ পুরনাে অভ্যাস মতাে প্রীতির চোখের দিকে চায়। সেখানে এক দারুণ উৎকণ্ঠা
কাটার মতাে বিধে আছে। জিজ্ঞেস করে,
কি হয়েছে তােমার প্রীতি? এখানে এভাবে?
শহীদ একদিন অনেক স্বপ্ন আমার চোখে ছিল । তােমার দীর্ঘশ্বাস আমার স্বপ্নকে
পুড়িয়ে দিয়েছে। আমি এক চরম অসুখি বিধ্বস্ত নারী । তুমি আমাকে ক্ষমা করাে
। আমি তােমাকে প্রতারণা করেছি। প্রীতি, কান্না ভেজা কন্ঠে উত্তর দেয় ।
শহীদ পুনরায় জিজ্ঞেস করে,
কি হয়েছে তােমার? কাঁদছাে কেন এভাবে?
দেশ
স্বাধীন হলাে। মুক্তিযােদ্ধারা বিজয়ীর বেশে দেশে ফিরলো । দেশের রাজনৈতিক
পটপরিবর্তনের সংগে সংগে প্রীতির শ্বশুর গা-ঢাকা দিয়ে দেশ ত্যাগ করেন।
স্বামী সহ প্রীতি সেখানেই ছিল । গুবরে পােকার মতাে লুকিয়ে গেল রাজাকার
আলবদরের দল। তারপর সুযােগ এলাে। সেনাবাহিনীর কিছু চরিত্রহীন কর্মকর্তাদের
সহায়তায় ক্রমে ক্রমে সকল রাজাকার প্রতিষ্ঠা পেল । দালালরা নেতা আর
শিল্পপতি হয়ে গেল । কেউ মন্ত্রী, কেউ আরও বড় কিছু হয়ে গেল । তাদের
গাড়িতে উড়লাে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত জাতীয় পতাকা। এই সুযােগে দেশে ফিরে
রাজনীতিতে অংশ নেয় প্রীতির স্বামী। তার পরের ঘটনা সবই জানা। এখন সে খুনের
আসামী । বর্তমানে জেল হাজতে অবস্থান এবং তাকেই বাচানাের জন্য প্রীতির
এখানে আগমন। প্রীতির কথা থেকে বিষয়গুলো উপলদ্ধি করে শহীদ।
শহীদ জানে
প্রীতি আজ তার কেউ নয়। তবু আজও সে তার জীবনের একটি অধ্যায়। প্রয়ােজনে
তার জন্য নিজ জীবনটা দিতে শহীদের আপত্তি নেই। কিন্তু একদিনের লাখ লাখ মানুষ
হত্যাকারী এবং নারী নির্যাতনকারী দালালের বেইমান পুত্রের জন্য তার পরম
আদরের প্রীতির একি ধরনের চাওয়া? শহীদ লজ্জিত হয়। অপমানিত হয়। হাজার
হাজার তরুণ-তরুণী যুবক-যুবতী, বৃদ্ধ দেশের জন্য প্রাণ দিল এক সময় । লাখ
লাখ নারী ইজ্জত হারালাে যাদের বেইমানীতে, অপর এক নারী তাদের একজনকে
বাঁচানাের জন্য আজ একি আচরণ করছে তার সংগে? রক্তে এক অদ্ভুত নাচন অনুভব করে
শহীদ। মনে মনে ভাবে, এ দেশটাই বড় বেইমান, হারামজাদা। নিজেকে সামলায়
শহীদ। প্রীতি রুমালে চোখের পানি মুছে, শান্ত কণ্ঠে বলে,
তােমার স্ত্রী,
সন্তান, ওরা...
শহীদ নিরুত্তর থাকে। নিঃশব্দে উঠে দাঁড়ায়। একটা সিগারেট
হাতে নেয় । আবার তা রেখে দেয় টেবিলে এবং ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার খুলে
একটি হাত ঘড়ি বের করে দেখায় প্রীতিকে। উদাস কণ্ঠে বলে,
এই ঘড়িটি কি
চিনতে পার? এর ছোয়ায় কিসের ছায়া আমার অঙ্গে মিশে থাকে জানাে? তােমার এ
ছোঁয়া নিয়েই তাে আমি আজও বেঁচে আছি। কিন্তু প্রীতি তুমি এমন একটি অনুরােধ
করলে, যা রক্ষা করলে, তােমার ছোঁয়া পাওয়ার মতাে আমার আজীবনের
এ গর্ব ম্লান হয়ে যাবে। তুমি কি চাও তােমার স্বামীকে বাঁচাতে যেয়ে আমি
তোমাকে হারাই
এীতির মনে পড়ে, হিরণ পয়েন্ট রেস্টহাউসের সেই স্মরণীয় রাতের
প্রায় ভুলে যাওয়ার কথা। সহসাই মুখ নিচু করে, সশব্দে কেঁদে উঠে। দু’হাতে
মুখ ঢাকে এবং শহীদের কোলের মধ্যে মুখ লুকায়। তীরবিদ্ধ কবুতরের মতাে তার
নরম দেহ কান্নায় দোলায় পনিত হতে থাকে অনেকক্ষণ ধরে।
শহীদ ভুলে যায়,
প্রীতি এখন তার নেই। সে পরস্ত্রী। সে দু হাতে জড়িয়ে ধরে প্রীতির হর হর
কম্পনরত তন্বী দেহ। তার কোমল বুকে কান লাগিয়ে সে হৃদয়ের শব্দ শােনে। এ
শব্দ অতি পরিচিত। একান্তই তার নিজের।
শহীদ দূরে, বহুদূরে হিরণ পয়েন্টের
সেই নির্জন ডাকবাংলাের সেই রাতের মতাে শূন্য হৃদয়ের ভেতর সমুদ্রের গর্জন
শুনতে পায়। সমুদ্র কাঁদছে, কিন্তু কিই করা আছে তার।




কোন মন্তব্য নেই