Header Ads

অপেক্ষা (আহসানুল হক আশিক) ছোট গল্প।


অপেক্ষা

লেখক
আহসানুল হক আসিক

অপেক্ষা

সােনার চামচ মুখে নিয়ে সম্বস্তি এক মুসলিম পরিবারে কোন এক সকাল বেলায় জন্ম নিল ছেলেটি, ঠিক যখন শিউলি ফুল মাটিতে ঝরে পড়ে। দুই তিনদিন পার হয়ে গেলেও সবাই যখন ছেলেটার নাম নিয়ে মহা বিপত্তিতে ঠিক সেই সময় বিচক্ষণ বাবা অনেক ভেবে চিন্তে ছেলের নাম ঠিক করলেন শুভ্র’ । শিউলি ফুলের পাপড়ির মতই ধবধবে সাদা, আর কমলা রঙের বৃন্তের মতই ঠোঁটগুলাে।

পরিবারে আনন্দের বন্যা বইছে। কিছুক্ষণ পরপরই বাবা তার ছেলের খোঁজ নেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় সবাইকে বলে দিয়েছেন, তার ছেলের গায়ে যেন একটা ফুলের টোকাও না পড়ে। মা তার ছেলেকে অনেক যত্নে রাখলেও বাবা তার ছেলের যত্নের। ব্যাপারে মাকে সবসময় সাবধান করে দেন ।

ঠিক যেমনটি আশা করেছিলেন, তেমনই একটা ছেলে হওয়াতে তিনি নিজেকে ভাগ্যবান এবং একই সাথে গর্বিত মনে করেন। ব্যবসায়ী বাবা নানা কাজে ব্যস্ত থাকাতে আগে তেমন বাসায় আসার সময়ই পেতেন না, কিন্তু ছেলে হওয়াতে এখন ব্যবসার দিকে তার মন নেই বললেই চলে। সারাদিন ছেলের সাথে সময় কাটান, গল্প করেন। মা সহ বাসার অন্য সবাই বাবার এই ছেলেমানুষি দেখে মুচকি মুচকি হাসে, কিন্তু কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।

ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে ছেলেটি। হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শুরু করে। বাবা তার ছেলেকে চোখে চোখে রাখেন। কোলে করে নিয়ে থাকেন সবসময়। ছেলের খেলনার জন্য এমন কোন খেলনা নেই যে তিনি কিনে আনেন নি ।

একদিন বারান্দায় বসে খেলা করছে শুভ্র। বারান্দায় রেলিং ধরে ওঠে দাঁড়ালাে সে। ঠিক সেই সময় বাবা চিৎকার করে সবাইকে ডাক দিয়ে বলতে লাগলেন- দেখ দেখ! আমার শুভ্র দাঁড়াতে পারে।

এই বলে পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলেন শুভ্র বারান্দায় পড়ে গেছে। ব্যথা পেয়ে চিৎকার করে কেঁদে উঠল সে। সাথে সাথে ছেলেকে কোলে তুলে নিলেন। বাবা, বাবা আমার কাঁদে না, লক্ষ্মী বাবা আমার ছেলের মুখে কপালে চুমু খেতে খেতে বললেন।

এখানে আর এক মুহূর্তও না, বারান্দায় আর কেউ কখনও আসবে না। বলতে বলতে উচ্চ শব্দে বারান্দার দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। শুভ্রকে কোলে দিয়ে বললেন- আমার ছেলের যেন কিছু না হয়।

ছেলের বাবার এরকম আচরণ দেখে সবাই অবাক। মুখ টিপে টিপে সবাই তখন হাসছিল। মা ছেলেকে কোলে করে নিয়ে ঘরের ভেতরে গেলেন। আর বাবা রাগে গজগজ করতে করতে হন্তদন্ত হয়ে বাহিরে বের হয়ে গেলেন। ছেলের প্রতি তার এই পাগলের মত ভালবাসা দেখে সবাই একেবারেই অবাক।

দিন যায়, মাস যায়, শুভ্র ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে।

বাবার সাথে এক টেবিলে বসে খায়। খাবার সময় মাছের মাথা, আর না হয় মাংসের বড় টুকরাটা নিজে নিজেই ছেলের পাতে তুলে দেন। মাঝে মাঝে মা আপত্তি করে । বাবাঃ আমার ছেলে এখন বড় হচ্ছে না? ওকে খেতে হবে তাে।

মা: হ্যা।

আজ স্কুলে শুভ্রর প্রথম দিন। বাবা ওকে প্রধান শিক্ষকের কাছে নিয়ে গেলেন। পূর্ব পরিচিত হওয়ায় আড়াটা ভালই জমে উঠল । প্রধান শিক্ষক লালসাদা মিষ্টি চেহারার এই ছেলেকে দেখেই খুব খুশি হলেন। পকেট থেকে একটা চকোলেট বের করে শুভ্রর হাতে দিলেন। আর অমনি শুভ্র চকোলেটটা ছিড়ে মুখের ভেতরে পুরল ।

বাবা: স্যার, আমার শুভ্রকে আমি আপনার কাছে দিয়ে গেলাম । আজ থেকে ওর সব দায়িত্ব আপনার। প্রধান শিক্ষক: আমি আমার সবাত্মক চেষ্টা করব ।

বাবা: আমার একটাই স্বপ্ন আমার ছেলেকে ইঞ্জিনিয়ার বানাব।

প্রধান শিক্ষক ও নিশ্চয় আপনার স্বপ্ন পূরণ করবে।

সেদিন স্কুলের খাতায় শুভ্রর নাম লিখে দিয়ে চলে এলেন তিনি। বাসায় যাওয়ার পথে ছেলের জন্য পেনসিল, বাবার, ব্যাগ, কলম সবকিছু কিনেন। আর সাথে ওর প্রিয় এক বাক্স চকোলেট ।

ঘাড়ে নতুন ব্যাগ ঝুলিয়ে রীতিমত দুলতে দুলতে হাঁটতে লাগল ও চকোলেটটা মুখে লেগে গেছে ওর। হাত চেটে চেটে খাচ্ছিল। ও কি যে খুশি হয়েছে তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না।

শুভ্র এখন নিয়মিত স্কুলে যায় । বাবা সকালে যাওয়ার সময় শুভ্রকে স্কুলে দিয়ে যায় । আর মা ওকে আনকে যায় । স্কুলে সে আজ কি কি করেছে তা প্রথমে ওর মাকে এবং পরে বাবাকে বলে । বাবা সারাদিন বাসায় না থাকায় মায়ের সাথে এবং পরিবারের অন্যান্য লােকদের সাথে সে সময় কাটায়। বাবা কখন আসবে এই জন্য সে অপেক্ষা করে। বাবা বাসায় এলে বাবার সাথে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গল্প করে।

এই বয়সে সে বাবাকে মাঝে মাঝে এমন প্রশ্ন করে যে এর উত্তর দিতেও বাবাকে মাঝে মাঝে দুচার মিনিট ভাবতে হয়। ছেলের এরকম জ্ঞানপিপাসা দেখে বাবা খুব খুশি হন। আর মনে মনে বলেন- আমার ছেলে। 

শুভ্রর কাছে তার বাবা একজন মহান পুরুষ । সে তার বাবাকে একজন আদর্শ ভাবে। বাবার সাথে তার এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক তাকে অন্যান্য বিষয়ে এগিয়ে নিয়েছে । স্কুলের বন্ধুরা যখন তাদের বাবাকে নিয়ে অনেক কথা বলে, তাদের বাবাদের কড়া শাসন নিয়ে বলে,তখন সে সবাইকে একটা কথাই বলে, আমার বাবা অনেক ভাল, আমার বাবা আমার খুব ভাল বন্ধু ।

শুভ্র ধীরে ধীরে বড় হতে থাকে। স্কুল পার করে সে এখন হাই স্কুলে।

এসএসসি পরীক্ষাতেও কাঙ্খিত ফলাফল করে সে। বাবা ছেলের এই সাফল্যে সবাইকে মিষ্টিমুখ করান। কলেজে উঠেছে শুভ্র। আর কয়েকমাস পরেই ওর এইচ এসসি পরীক্ষা । বাবা মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন, আর কটা দিন বাবা, একটু কষ্ট করাে।

মা বলেন, তুমি পারবে বাবা ।

মাঝে মাঝে শুভ্র নিজেকে পৃথিবীর সব থেকে সুখী মানুষ মনে করে। সে তার বাবা মার এত ভালবাসা পেয়েছে যে তার জীবনে আর চাওয়ার কিছুই নেই। এখন শুধুই বাবা মার ইচ্ছা পূরণ করার অপেক্ষা। এইচ এস সি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হল । শুধুমাত্র বাংলা ছাড়া সে অন্য সব বিষয়ে এ প্লাস পেয়েছে ।

একটু মন খারাপ হল ওর, তাতে কি?

বাবা মা ওকে সান্তনা দিলেন।

ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার জন্য শুভ্র দিনরাত পড়াশুনা করতে লাগল। তবে একটা নেশা, যা তাকে পড়াশুনার ভেতরে আটকে রাখতে পারে নি। এমনকি বিগত পরীক্ষাগুলাের সময়ও এই নেশা তাকে কিছুতেই ছাড়ে নি। ক্রিকেট খেলার এই নেশাটা এখন রীতিমত তার জীবনের একটা অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাছাড়া এলাকায় একজন ভাল ক্রিকেটার হিসেবে সবাই ওকে চেনে। রাত বিরাতে বাবার সাথে বসে খেলা দেখে।

তখন অবশ্য টি-২০ ম্যাচ চলছিল । বাবা, ছেলে দুজন চুপচাপ খেলা দেখে মাঝে মাঝে নিজেদের দলের ভাল পারফরমেন্স দেখলে চিৎকার করে লাফিয়ে ওঠে। তাদের দুজনের চিৎকারে মাঝে মাঝে বাসার অন্যদের ঘুম ভাঙে কিন্তু বিরক্ত হয়ে পরে আবার ঘুমিয়ে পড়ে ।

সময়গুলাে খুব দ্রুত চলে যাচ্ছিল। এদিকে পরীক্ষাও এসে যায়। অবশেষে দেশের একটি নাম করা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় শুভ্র। তবে তার পছন্দের বিষয়ে ভর্তি হতে পেরে সে সত্যিই খুব খুশি হয় । 

এদিকে বাবার মনের ইচ্ছা পূরণ করতে পারায় সে নিজেকে তার বাবার কাছে যোগ্য ছেলে হিসেবে খুব গর্ব বােধ করে। আর বাবা বুকে টেনে নিয়ে কপালে চুমু দেয় ।

বাবাঃ  আমার ছেলে..

আনন্দে বাবা মার চোখে জল আসে। নতুন বছর চলে আসে । এদিকে নতুন ক্লাসও শুরু হবে। বিদায় নেওয়ার দিনে শুভ্র কিছুতেই মন থেকে যেতে চাচ্ছিল না। মাকে ধরে খুব কান্নাকাটি করে। মা ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় । মা ও সব সময় নিজের খেয়াল রেখ বাবা ।

একে একে সবার থেকে বিদায় নিল শুভ্র। বাসার এই ছােট্ট আদরের ছেলেটিকে যেতে দিতে সবার খুব কষ্ট হচ্ছিল। বাবার সাথে শুভ্র রওনা হয়। যাত্রার সম্পূর্ণ পথটা শুদ্র বাবার সাথে ভালভাবে কথা বলে নি । বাবা ছেলের মনের অবস্থা বুঝতে পেরে ওকে সান্তনা দেন।

বাবা আমি যাব না এই কথাটা মুখ দিয়ে না বলতে পারলেও ওর চোখে মুখে তা স্পষ্ট ফুটে উঠেছে । শুভ্রকে ভর্তি ও থাকার ব্যবস্থা করে দিয়ে বাবা যখন বিদায় নিতে যাবেন, ঠিক তখনই ডুকরে কেঁদে উঠল শুভ্র ।

বাসা থেকে বিদায় নেওয়ার সময় ও এরকম কাদেনি। বাবাও শুভ্রকে বুকে টেনে নিয়ে অনেকক্ষণ কাঁদলেন। বাবা নামের এই লােকটি যে তার জীবনের সবচেয়ে ভাল বন্ধু এখন সেকথা মনে করে, সে কিছুতেই চাইছিল না, যে বাবা চলে যাক । শুভ্রকে সান্ত্বনা দিয়ে বাবা ওর থেকে বিদায় নিলেন।

কিছুদুর যাওয়ার পর পেছন থেকে শুভ্র চিৎকার করে কেঁদে বাবা বলে ডাক দেয়। ঠিক শেষবারের মত এরকম আরও একটি ডাকের জন্য বাবাও অপেক্ষা করছিলেন সামনে থেকে। দুজন দৌড়ে এসে দুজনকে জড়িয়ে ধরে আবার কাঁদে। অবশেষে শুভ্রকে বিদায় দিয়ে বাবা চলে আসেন ।

মেয়ে মানুষের মত তিনি কাঁদতে পারছিলেন না ঠিকই। কিন্তু চোখের জল কিছুতেই থামাতে পারছিলেন না। আজ কেউ যদি তার ক্ষতবিক্ষত হৃদয়টা দেখতে পেত, তাহলে পুরুষ মানুষকে কেউ কোনদিন পাষাণ বলতে পারত না ।

শুরু হল নতুন পরিবেশে টিকে থাকার লড়াই ।

চারপাশের মানুষগুলাে সব অচেনা। সারাদিন একা একা থাকে, একা একা ক্লাসে যায়, এই ছেলেটি । বন্ধুদের সাথে ধীরে ধীরে ওর সম্পর্ক ভাল হতে থাকে। নতুন পরিবেশে বন্ধুদের সাথে এক নতুন জগতে সে বাস করতে শুরু করে। এত কিছুর ভিড়েও কিসের যেন একটা অপ্রাপ্তি। সে তার প্রতি পদক্ষেপে বাবাকে অনুভব করে। 

খেলার মাঠে ব্যাট হাতে দাঁড়িয়ে থেকে আশে পাশে তাকিয়ে কাউকে যেন খুঁজে বেড়ায়। তার মনে হয় যেন পাশ থেকে বাবা বলছে - শুভ্র এগিয়ে যাও' । সে দিন ভার্সিটিতে একটা বড় অনুষ্ঠান হল। শুভ্র ওতে অংশ নিয়েছিল। বাবাকে ফোন করে সব কিছু জানিয়েছে ও। সারাদিন বন্ধুদের সাথে অনেক মজা করে হলে ফেরে রাতে।

খেয়েদেয়ে বন্ধুদের সাথে ঘুমিয়ে পড়ে। মাঝরাতে হঠাৎ ‘বাবা বাবা’ করে চিৎকার করে ঘুম থেকে উঠে বসে। বন্ধুদের সবার ঘুম ভেঙ্গে যায় ।

কি হয়েছে?

সবাই জানতে চাইলে ও শুধু একটা কথাই বলে- কিছু না।

বাবা....

ঠিক তখনই শুভ্র বাবাকে ফোন দেয়। গভীর রাতে শুভ্রর ফোন পেয়ে বাবাও কিছুটা বিস্মিত হন। ফোন রিসিভ করে তিনিও পাশ থেকে কিছুই শুনতে পেলেন না, তবে কেউ যে ও পাশ থেকে কাঁদছে সেটা তিনি স্পষ্টই বুঝতে পারলেন ।

বাবাঃ কি হয়েছে বাবা?

শুভ্র: তুমি কেমন আছ বাবা? মা কেমন আছে? তােমাদের খুব মনে পড়ছে। কান্না জড়ানাে কণ্ঠে ও পাশ থেকে ফোনে কথাগুলাে বলছিল শুভ্র । ছেলের কথা শুনে বাবাও তার চোখের পানি ধরে রাখতে পারলেন না।

বাবা: আমরা ভাল আছি বাবা। তুমি কোন চিন্তা করাে না, সব ঠিক হয়ে যাবে । এরই মধ্যে মাও জেগে গেছেন। তিনিও শুভ্রর সাথে কথা বলে কাঁদলেন । একমাত্র ছেলেকে দুরে পাঠিয়ে বাবা মা কত রাত যে চোখের জলে বুক ভাসিয়েছেন তা কেবল তারাই জানেন।

দিনগুলাে ভালই কাটছিল শুভ্রর।

এরই মধ্যে প্রায় তিন মাস কেটে গেছে। পরীক্ষাও প্রায় শেষের দিকে। বাড়ি যাওয়ার এক আনন্দ ওর মধ্যে কাজ করছে। তাই বসে বসে ও শুধু দিনগুণতে থাকে । কবে পরীক্ষা শেষ হবে, কবে বাড়ি যাবে। দিন পনেরাে আগে সে বাবাকে ফোনে বলেছে- বাবা আমি আসছি।

চারদিন পর একটি পরীক্ষা তারপর তিনদিন করে ছুটি দিয়ে মাঝে আরও দুটি  পরীক্ষা।

বিকালে নাস্তা করে হলের দিকে আসছিল শুভ্র। এমন সময় অচেনা নম্বর থেকে ওর ফোনে একটা কল আসে। ফোনটা রিসিভ করে কানে ধরল ও।

শুভ্র: হ্যালাে,কে বলছেন? 

শুদ্র আমি তােমার হামিদ আঙ্কেল

শুভ্র প্রথমে চিনতে পারল না। পরে ঠিকই চিনতে পারল । ওর বাবার খুব কাছের বন্ধু।

শুভ্র: হ্যা আঙ্কেল, কেমন আছেন?

আঙ্কেল: বাবা, আজ একটু বাড়ি আসতে পারবে? তােমার বাবা একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছেন।

কথাটা শােনার পর কি করবে ও ভেবে পায় না। দৌড় দিয়ে ওর রুমে এসে সবকিছু গুছিয়ে নেয়। বন্ধুরা ওকে কি হয়েছে জিজ্ঞাসা করলে ও কোন কথার উত্তর দেয় না। ঘাড়ে ব্যাগ নিয়ে যাবার সময় বন্ধুদের শুধু একটা কথাই বলে- আমি গেলাম, তােরা ভাল থাকিস।

বন্ধুরা কেউ কিছুই বুঝল না।

শুভ্র যখন বাড়ি পৌছল তখন বাবা মা কাউকে বাড়িতে পেল না। বাবা, বাবা, মা মা বলে চিৎকার করে ডাকতে লাগল । তখন বাসার কাজের লােক রতন কাকা বের হয়ে এসে ওকে বলে।

রতন ঃ বাবাজি , তুমি এসেছে! তােমার বাবা খুব অসুস্থ। হসপিটালে ভর্তি করা হয়েছে।

রতন কাকার কথা শুনে শুভ্র কি করবে ভেবে পায় না। বাবার অসুস্থতার কথা শুনে শুভ্র পাগল প্রায় হয়ে যায়। রতন কাকাকে সাথে নিয়ে হসপিটালের দিকে রওনা হয় শুভ্র।

যেতে যেতে ঘণ্টা দুএক লেগে যায়। হাসপাতালে যখন পৌছালাে তখন সেখানে অনেক পরিচিত মানুষ। প্রথমেই হামিদ আঙ্কেলের সাথে দেখা হল শুভ্রর।

শুভ্রঃ আঙ্কেল বাবা কেমন আছে, বাবা কোথায়?

হামিদ আঙ্কেল কোন কথা বললেন না। প্রথমে চুপ করে থেকে কিছুক্ষণ পর বললেন- সব ঠিক হয়ে যাবে, বাবা শুভ্র যখন সিসিইউ রুমে পৌছালাে তখন সে দেখে তার বাবার দেহটা নিথর হয়ে বেড়ে পড়ে আছে। শরীরের বিভিন্ন স্থানে তার লাগানাে হয়েছে। আর মা পাশে বসে কাঁদছিলেন। এই অবস্থা দেখে শুভ্রও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল।

শুভ্র: মা, বাবার কি হয়েছে? বাবা কথা বলে না কেন? ডাক্তার আঙ্কেল, বাবার কি হয়েছে?

শুভ্রর মা ওকে শান্ত করতে চেষ্টা করছিলেন, কিন্তু শুভ্র কিছুতেই শান্ত হচ্ছে না। অবশেষে ডাক্তারের কথায় শুভ্রর মা আর হামিদ আঙ্কেল শুভ্রকে অনেক কষ্টে সি সি

ইউ রুম থেকে বাইরে বের করে আনেন। সিসি ইউ থেকে বের হয়ে এসে শুভ্র পাগলের মত প্রলাপ বকতে থাকে।

বাবার কিছু হবে না, বাবা ভাল হয়ে যাবে।

মা ওকে অনেক চেষ্টা করে বাসায় পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করলেন, কিন্তু, কিছুতেই বাসায় যেতে চাইল না।মা এর সাথে হসপিটালে থেকে যায় শুভ্র । অসুস্থ বাবার জ্ঞান ফেরে না। রাতে বাবার এক পাশে শুভ্র আর অন্যপাশে মা বসেছিলেন। রাতে পুরাে সিসিইউ রুমে নিরবতা। মা বসে ঝিমুচ্ছিলেন। কিন্তু শুভ্রর চোখে ঘুম আসে না। এক দৃষ্টিতে বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকে, এই বুঝি বাবা চোখ খুলে ওর দিকে তাকাবে ।

রাত পেরিয়ে সকাল হল। তখনও বাবার জ্ঞান ফিরে নি। এদিকে সারা রাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি শুভ্র। সকাল বেলা ওর রক্ত লাল চোখ দেখে মায়ের সে কথা বুঝতে বাকি রইল না। ঠিক দুপুরে শুভ্রর বাবার জ্ঞান ফিরল । বাবাকে চোখ মেলতে দেখে শুভ্র অনেক খুশি হয় । কাছে গিয়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে শুদ্র ।

শুভ্র: বাবা, তুমি কেমন আছ? তােমার কিছু হয় নি বাবা! তুমি ঠিক হয়ে যাবে ।

বাবা: হ্যা বাবা, আমার কিছু হবে না। আমার শুভ্র এসেছে না?

কথাগুলাে বলতে বলতে শুভ্রর কপালে গালে চুমু খাচ্ছিলেন তিনি। ডাক্তার এসে এরই মধ্যে, বলে গেছেন যে, শুভ্রর বাবার হার্টের একপাশে একটা ব্লকেজ ধরা পড়েছে । ভালভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে ।

অনেকটাই সুস্থ হয়ে গেছেন শুভ্রর বাবা। ডাক্তার কাল সকালেই রিলিজ করবেন। বাবা ছেলের মধ্যে অনেক দিন পর আড্ডাটা আবার জমে উঠল। আশেপাশের বেডের রােগীরা বাবা ছেলের এরকম সম্পর্ক দেখে অবাক হন ।

সেদিন রাত্রে শুভ্রের বাবা হঠাৎ করে আবারও হার্ট এটাক করলেন । শুভ্র আর ওর মা ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করতে লাগল। বাবা আবার আগের মত নিরব হয়ে গেছেন । তার জ্ঞান নেই। শুভ্র ও ওর মা কাঁদতে লাগল অঝােরে। মাঝরাতে হঠাৎ করে বাবার জ্ঞান ফিরল। পাশ ফিরে শুভ্র ও ওর মাকে ভাল করে দেখে নিলেন। তারপর শুভ্রকে কাছে ডাকলেন । প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল তার কথা। বলতে । শুভ্রর হাতটা ধরে কিছু একটা বলার চেষ্টা করতে লাগলেন। কিন্তু তার কথা শােনা গেল না। শুধু মুখ নাড়াতে নাড়াতে শুভ্রর হাতটা উনার বুকের উপর ফেলে দিলেন । তারপর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন।

শুভ্র: বাবা, বাবা।

বাবা কোন কথা বলছে না দেখে শুভ্র তাড়াতাড়ি ডাক্তারকে ডেকে নিয়ে এলেন।

ডাক্তার ভালভাবে দেখে বললেন, 'He is no more.

ডাক্তারের কথা শােনার সাথে সাথেই শুভ্র আর ওর মা হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল শুভ্র: বাবা, বাবা, এই বাবা, ওঠো। তুমি আমার কথা শুনতে পাচ্ছি না, আমি তােমার শুভ্র।

শুভ্রর কথাগুলাে বিশাল সিসিইউ রুমে প্রতিধ্বনিত হচ্ছিল।

বাবা আর উঠল না। সকালে খবর পেয়ে সকল আত্মীয় স্বজন হাসপাতালে এল। এতােক্ষণে শুভ্র প্রায় পাগল হয়ে গেছে। আর মা মুখে শাড়ির আঁচল চেপে ধরে কাঁদছিলেন ।

শুভ্র: হামিদ আঙ্কেল, বাবা কথা বলে না কেন? বাবার কি হয়েছে? রতন কাকু বাবা আমাদের সাথে বাসায় যাবে না?

হাসপাতালে একে একে আত্মীয়দের ধরে ধরে সবাইকে এই কথাগুলাে জিজ্ঞাসা করছিল শুভ্র । কিন্তু কেউ ওর কথার জবাব দিতে পারল না। শুধু মাথায় হাত দিয়ে চোখের পানি মুছে দিল ।

মাকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে শুভ্র, আর থেমে থেমে বাবা বাবা বলে চিৎকার করে ডাক দিয়ে ওঠে।

মিষ্টি চেহারার এই বালকের এই অবস্থা দেখে আশে পাশের সবাই যখন ঘটনাটা জানতে পারল তখন কেউ আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না।

হামিদ আঙ্কেল: কেঁদো না বাবা। আমরা সবাই আছি। সব ঠিক হয়ে যাবে। বলে শুভ্রকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন ।

বাবার মৃত্যুর পর শুভ্র কেমন যেন হয়ে গেল । হাসিখুশি ছেলেটা কারও সাথে কথা বলে না, ঠিকমত খাওয়া দাওয়া করে না। বাবার মৃত্যুটাকে সে কোনভাবেই মেনে নিতে পারছিল না।

মা চোখের জলে সারাদিন বুক ভাসান । শুভ্র মার কাছেও আর যায় না। খানিকক্ষণ পরপর বাবা বাবা বলে এঘর ওঘর ছুটে বেড়ায়। এদিকে ওর ভার্সিটির বন্ধুরা ওকে ফোনে না পেয়ে অনেক কষ্টে ওদের বাসায় চলে আসে । শুভ্রর বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে ওরা শুধু ওকে সান্ত্বনা দেয়।

দুদিন পর পরীক্ষা। তাই বন্ধুরা ওকে সাথে নিয়ে যেতে চাইল। কিন্তু শুভ্র ওদের সাথে যেতে রাজি হল না। বাধ্য হয়ে বন্ধুরা ওকে ছেড়ে চলে যায় ।

এদিকে বাবার মৃত্যুর শােকে শুভ্র পাথর হয়ে যায় । তার মধ্যে আগের সেই চাঞ্চল্য আর নেই । ভার্সিটিতে ফিরে না যাওয়াতে শেষের তিনটা পরীক্ষা আর দেওয়া হয় না ওর । বন্ধুদের সাথেও যােগাযোগ একেবারে বন্ধ করে দেয়।

সব সময় একটা কথা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়- সে যদি ডাক্তার হত তা হলে হয়তাে তার বাবাকে বাঁচাতে পারত। কিন্তু তার বাবার স্বপ্নটাকে সে পূরণ করতে পেরেছে । ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে চান্স পেয়েছে । আজ তার বাবা মারা গেছে, হয়তাে ভবিষ্যতে এরকম অনেক শুভ্রর বাবাই ভাল চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে। এদেশের ডাক্তারদের প্রতি তার একটা খারাপ ধারণা জন্ম নেয়। তাই সে মেডিকেল কলেজে পরীক্ষা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তাহলে যে বাবার স্বপ্নটা পূরনই হবে না। এরকম এক অনিশ্চয়তার মধ্য দিয়ে দিন কাটাতে থাকে শুভ্র।

শুভ্রর সাথে যােগাযােগ না হওয়াতে পরীক্ষা শেষে ওর বন্ধুরা আবার ওর সাথে দেখা করতে আসে। শুভ্র ওদেরকে ওর মনের কথা খুলে বলে।

বন্ধুরাও ওকে ইন্সপায়ার করে ‘তুই পারবি শুভ্র, এখনও সময় আছে' পড়তে বসলেই শুভ্রর মধ্যে একটা ক্ষোভ ও রাগ কাজ করে। মনে হয় যেন বইয়ের পাতাগুলাে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করবে, কিন্তু করে না। তার এই রাগ তাকে আরও সাহস দেয় ।

দেখতে দেখতে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষা এসে গেল।

ভাগ্য যখন সাহসীদের সহায় হয়, তখন শুভ্রর ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হবে কেন? ভাগ্য ঠিকই ওকে মেডিকেলের বারান্দায় টেনে আনে।

তবে নিয়তিও মনে হয় কু হাসি হাসে। আর হয়তাে এই জন্যই সেই মেডিকেলেই শুভ্র চান্স পেয়েছে যে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শুভ্রর বাবা মারা গেছে ।

যে দিন মেডিকেল কলেজে প্রথম ক্লাস সেদিন শুভ্র একাই বাড়ি থেকে বিদায় নেয় । মা সাথে যেতে চাইলেও মাকে ও নেয় না। কলেজের প্রধান গেটে এসে হঠাৎ ওর মনে হল গত বছর এই সময়ের কথা। বাবার কথা মনে করে কাঁদতে কাঁদতে শুভ্র কলেজের দিকে চলে গেল।

শুরু হল শুভ্রর মেডিকেল জীবন।

পড়াশুনার চাপটা এখানে অনেক বেশি। কিন্তু শুভ্রর এই পড়াশুনার দিকে তেমন কোন টানই ছিল না। তবে পরীক্ষার আগে পড়াশুনা করত শুধু। আর তাতেই একটা মােটামুটি ভাল রেজাল্ট করত। ফর্সা রঙের এই ছেলেটা খুব অল্প দিনেই সবাই নজর কাড়ে। সকলের কাছে খুব প্রিয় হয়ে যায়। তবে ওর মধ্যে যে একটা নীরবতা কাজ করত, তা সবাই বুঝতে পারে। দুএকজন সাহস করে এর কারণ জানতে চাইলে একটা স্লান হাসি দিয়ে অন্য প্রসঙ্গে চলে যায়।

প্রথম বছরের প্রায় মাঝামাঝি সময় । দ্বিতীয় কার্ড ফাইনাল পরীক্ষার তারিখ দিয়ে দেয়। পরীক্ষার দুদিন আগে থেকে শুভ্র খুব পড়াশুনা শুরু করে দেয়। সারারাত পড়াশুনা করে।

পরীক্ষার আগের দিন পড়াশুনা শেষ করে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ওর রুমমেট জাহিদকে ভােরবেলা ডেকে দেওয়ার জন্য বলে।

পরদিন ভােরবেলা উঠতে জাহিদের একটু দেরিই হয়। তবে ও উঠে দেখে শুভ্র ঘরে নেই । এদিকে পরীক্ষার সময়ও খুব কাছে আসে । শুভ্ররও কোন খবর নেই। সমস্ত কলেজ হােস্টেলে খোঁজাখুঁজির পরও যখন শুভ্রকে পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ওর ফোনে সবাই কল দিল। কিন্তু ওর ফোনটাও তখন বন্ধ ছিল। অবশেষে শুভ্রকে ছেড়েই একা একা পরীক্ষা দিতে গেল জাহিদ।

পরীক্ষা শেষ হলে সবাই যখন হােস্টেলে যে যার রুমে ফিরল তখন রুমের ভেতরে শুভ্রকে দেখে জাহিদ রীতিমত অবাক হয়ে গেল ।

জাহিদ: দোস্ত তুই কোথায় গেছলি? পরীক্ষা দিলি না কেন?

শুভ্র: একটু কাজ ছিল ।

জাহিদ; তাই বলে পরীক্ষা দিবি না?

শুভ্র: বললাম তাে কাজ ছিল । একটু কড়া গলায় বলল শুভ্র । শুভ্র রেগে যাচ্ছে দেখে জাহিদও ওকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করল না ।

জাহিদ: চল খেতে যাবি না?

শুভ্র: ইম, চল।

অনিকা শুভ্রর ব্যাচেরই একটি মেয়ে। দেখতে অনেক সুন্দর। মাঝারি উচ্চতা । শুভ্র ও অর্নিার রােল পাশাপাশি। পাশাপাশি রােল হওয়াতে ওদের একসাথে অনেকগুলাে পরীক্ষাই দিতে হয়। মেয়েটিই সবসময় শুভ্রর সাথে কথা বলেছে। তবে এই ব্যাপারে শুদ্র ছিল বরাবরাই উদাসীন। তবে অর্নিকা যে ওকে খুব পছন্দ করত সেটা শুভ্র বেশ ভালভাবেই জানত। মাঝে মাঝে শুভ্রকে ফোন দিয়ে অনিকা ওর খোঁজ খবর নিত। পরীক্ষার আগের রাতে অর্নিকা শুভ্রর কাছে ফোন দিয়ে পরীক্ষায় ওকে দেখাতে অনুরােধ করত।

এভাবে ধীরে ধীরে শুভ্র ও অর্নিকার বন্ধুত্বটা একসময় ভালবাসায় রূপ নেয়। কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারে না। এমনকি লেকচার ক্লাসে একে অন্যকে দেখার জন্য আগেই এসে উপস্থিত হত। তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপর হল ফোনে ওরা একে অন্যের সাথে কথা বললেও সামনা সামনি দুজনের কথা খুব কমই হত ।

একদিন অনিকা শুদ্রকে অনুরােধ করে বাইরে দেখা করার জন্য। শুভ্রও অনেক দিন ধরেই এ কথা অনিকাকে বলবে ভাবছিল। তাই শুভ্রও রাজি হয়ে গেল। কলেজের বাইরে ওরা এক পার্কে দেখা করতে গেল। দুজন দুজনকে দেখে একটু মুচকি হাসল । তারপর দুজন পাশাপাশি বসল। 

প্রথম দেখা করতে এসে দুজনই অনেক নার্ভাস ছিল। তাই কেউ আগে কথা বলার সাহস পাচ্ছিল না।

ঠিক সেই সময় শুভ্র পেছন দিকে ঘুরে বসল । শুদ্র কিছু বলল না দেখে বিরক্ত হয়ে অর্নিকা ও পেছনে ঘুরে বসল। পকেট থেকে ফোনটা বের করে শুদ্র অনিকাকে একটা ফোন দিল। ব্যাগ থেকে ফোনটা বের করে কাঁপা কাঁপা হাতে রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরল অর্নিকা ।

শুভ্র: কিছু বলবে না?

অর্নিকা: কি বলব, তুমি বল

শুভ্র: ভালবাসি, I Love U.

অর্নিকা: আমিও ভালবাসি, I Love U too.

অনিকা পেছনে ঘুরে শুভ্রর ঘাড়ে হাত রাখতেই শুভ্রও পেছনে ঘুরে বসল। দুজন দুজনের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল । ভালবাসার অভিমানে অর্নিকার দুচোখ দিয়ে জল নেমে এলাে।

অর্নিকা: তুমি না?

শুভ্র: কি?

অর্নিকা: বড় বেশি ভাল ।

পকেট থেকে একটা আংটি বের করে অর্নিকার আঙ্গুলে পরিয়ে দিল শুভ্র ।

এটা সবমসয় সাথে রাখবে যখন আমার কথা মনে পড়বে তখন এটা দেখে নিও।

হু,

কথায় কথায় রাগে অভিমানে কয়েকটা ঘন্টা যে কেমন করে কেটে গেছে তা দুজনের কারও খেয়াল ছিল না। অবশেষে দুজন ক্যাম্পাসের দিকে রওনা দিল । কলেজ গেইটে এসে শুভ্র অনিকাকে ওর হােস্টেল গেইট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে চাইলে অর্নিকা ওকে না করে।

শুভ্র: তুমি যাও ।

অর্নিকা শুভ্রর জোড়াজুড়িতে শেষ পর্যন্ত হােস্টেলের দিকে হেঁটে রওনা দেয়। শুভ্র নিশুপ দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু দূর হেটে যাওয়ার পর অনিকা পেছন ফিরে শুভ্রর দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে শুভ্র তখনও দাঁড়িয়ে আছে ।

অর্নিকা: ভাল থেকো, বাই

শুভ্র: তুমিও ভাল থেকো, বাই ।

সেদিন রাত্রে শুভ্র খুব তাড়াতাড়িই ঘুমিয়ে পড়ে । পরদিন সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই দেখে দশটা বাজে। লেকচার ক্লাসের জন্য তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে ক্লাসে যায় । কিন্তু কপাল খারাপ,স্যার আগেই ক্লাসে ঢুকেছেন । শুভ্রর দিকে তাকিয়ে স্যার বললেন- তুমি কি সুনামিতে পড়েছিল?

ঠিক তখনই ক্লাসের সবাই হেঁসে উঠল ।

নিজের দিকে তাকিয়ে শুভ্র দেখল এপ্রনের উপরের দুটা বােতাম খােলা, পেছনে কলারটা উঠানাে আছে, আর চুল আচঁড়ানাের কথা মনেই নেই। লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে একেবারে সবার পেছনের সিটে গিয়ে বসে পরে ও। ক্লাস শেষে শুভ্রর সাথে অর্নিকার চোখাচোখি হল- অনিকাকে দেখেই বুঝা গেল যেও মনে মনে খুব কষ্ট পেয়েছে।

পরদিন সকাল বেলা ঘাড়ের উপর এপ্রনটা ফেলে খুব তাড়াহুড়া করে হাঁটছিল শুভ্র। পথে যেতে যেতে নাহিদের সাথে ওর জোরে ধাক্কা লাগে।

নাহিদ: দোস্ত, এতাে তাড়াহুড়াে করে যাস কই?

শুভ্র: দোস্ত, মিলি ম্যাডাম আমারে আজ চা খাওয়ার দাওয়াত দিছেন । যাই ম্যাডাম আবার মাইন্ড করবে।

নাহিদ কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না। তবে ওর বুঝতে বাকি নেই যে শুভ্র আইটেম দিতে যাচ্ছে। সামনে কার্ড পরীক্ষা। তাই আইটেম ক্লিয়ার করার জন্য ম্যাডাম ওকে ডেকে পাঠিয়েছেন ।

নাহিদ: পাগল ছেলে একটা।

একা একা হাসতে হাসতে হােস্টেলের দিকে চলে গেল।

সামনে থেকে নাহিদকে দেখে বাশার বলে উঠল- কিরে একা একা হাসিস কেন? পাগল হয়ে গেলি নাকি?

নাহিদ: হায় আল্লাহ!!

রাতে খাওয়া দাওয়ার পর শুভ্র অর্নিকাকে ফোন দিল ।

শুভ্র: কেমন আছাে অর্নিকা, তােমাকে খুব মিস করছি।

অর্নিকা: আমিও তােমাকে খুবই............ মিস করছি ।

শুভ্র: কাল তাে কার্ড পরীক্ষা, কেমন পড়লে?

অর্নিকা: আমার পড়া শেষ হয়নি এখনও। কাল কিন্তু অবশ্যই পরীক্ষা দেবে ।

শুভ্র: হা সেব।

অর্নিকা: আমার খুব ঘুম পাচ্ছে।

শুভ্র: ওকে, গুড নাইট।

সে দিন অনেক রাত পর্যন্ত পড়াশুনা করে ঘুমিয়ে পড়ে শুভ্র । সকালে উঠেই অর্নিকা শুভ্রকে ফোন দেয়। তবে ফোন বন্ধ ।

অনেক চেষ্টা করেও যখন পায় না, তখন অর্নিকা শুভ্রর রুমমেট জাহিদকে ফোন দেয়। জাহিদ অনিকাকে বলে যে, শুভ্র রুমে নেই।

এদিকে অর্নিকার রাগ ক্রমেই বেড়েই যাচ্ছিল। পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। অর্নিকার পাশে শুভ্রর সিটটা খালি । এখনও শুভ্র আসেনি। আশেপাশে সবাই লেখা শুরু করেছে। কিন্তু অর্নিকা এখনও কিছু লেখেনি । ও শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করেই যাচ্ছে । দশ মিনিট পর উচ্চ শব্দে স্যারের ধমক শুনে পেছনে ফিরে তাকিয়ে দেখে শুভ্র এসেছে। তাড়াতাড়ি করে খাতা প্রশ্ন হাতে নিয়ে লিখা শুরু করল শুভ্র । অনিকাও এবার হাতে কলম নিয়ে লিখা শুরু করল।

পরীক্ষা শেষে পেছন থেকে অর্নিকাকে ডাক দিলে শুভ্র। কিন্তু অর্নিকা ওর কথার কোন উত্তর দেয় না। রুমে এসে শুভ্র অনিকাকে ফোন দিলে অর্নিকা রিসিভ করে না । শুভ্র বুঝতে পারল যে অর্নিকা খুব রাগ করেছে। বিকালে শুভ্র ফোন দিতেই সাথে সাথে অর্নিকা রিসিভ করে ।

অর্নিকা: সকালে এতাে দেরি করলে কেন? তুমি মিথ্যাবাদী।

শুভ্র: রাগ করাে না, প্লিজ । আমার একটু কাজ ছিল ।

অর্নিকা: জানাে, তুমি না আসা পর্যন্ত আমি একটুও লিখিনি।

শুভ্র: হু, জানি । আর হবে না, প্লিজ

অর্নিকা: প্লিজ, এভাবে আমাকে আর কষ্ট দিওনা।

শুভ্র: কখনও ই না।

অর্নিকা: বিকালে বের হবে?

শুভ্র: হুম, ঠিক সাড়ে চারটায় ।

অর্নিকা: ওকে।

শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে শুভ্রর ঘুম ধরেছে বুঝতেই পারে নি। ঘুম থেকে উঠেই দেখে চারটা পয়ত্রিশ দ্রুত উঠে রেডি হয়। পারফিউমের বাটনে চাপ দিতেই যখন ভেতর থেকে শুধু বাতাস বের হয়ে এলাে তখন ওটাকে জানালার দিকে ছুঁড়ে দেয় ।

পাশে জাহিদের টেবিল হতে ওর পারফিউমটা নিয়ে স্প্রে করে দ্রুত রুম থেকে দৌড় দেয়।

শুভ্র যখন অনিকার কাছে পৌছালাে তখন ঠিক চারটা পঁয়তাল্লিশ। পুরাে পনেরাে মিনিট লেট । অর্নিকা খুব রেগে আছে ।

শুভ্র: প্লিজ, সরি, সরি, প্লিজ

অর্নিকা: সরি না? পনেরাে মিনিট।

অর্নিকা: ওকে।

অর্নিকা যেমন খুব সহজেই রেগে যায়, শুভ্রও তেমনি খুব সহজেই সরি বলে সব ঠিক করে নেয়। তবে শুভ্রর মায়াবি চেহারা আর অদ্ভুত এক হাসির কাছে অর্নিকার সকল অভিমান নিমেষেই হাওয়া হয়ে যায় । আর অর্নিকার নিস্পাপ মুখও শুদ্রকে কেমনজানি সব সময় একটা অপরাধি করে রাখে।

শুভ্র: জানাে অর্নিকা, সেদিন কি হয়েছিল?

অর্নিকা: কি হয়েছিল?

শুভ্র: আমি না, ফিমারটা উল্টা করে ধরে বলেছিলাম- This is the viscera of Femur of left side. হা , হা, হা হা, হা,হা।

শুভ্রর হাসিটা যেন কিছুতেই থামছে না । ও হেসেই যাচ্ছে আর অর্নিকা এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে । মনে মনে ভাবছে, একটা মানুষ এতাে সুন্দর করে কিভাবে হাসে!

শুভ্র: অর্নিকা, এই অর্নিকা

তখনও অর্নিকা শুভ্রর দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ।

শুভ্র: কি হলাে তােমার?

অর্নিকা: না , কিছু না।

শুভ্র একটার পর একটা কথা বলেই যাচ্ছে তখন থেকে। কিন্তু অর্নিকা কেমন জানি প্রথম থেকেই চুপচাপ। শুধু শুনেই যাচ্ছে । মুগ্ধ হয়ে শুনছে । ওর চোখ মুখে একটা চিন্তার ছাপ।

শুভ্র: Anything Wrong অর্নিকা । অনিকা তখনও চুপচাপ । নিজেকে ওর আজ বড় অসহায় লাগছে। মনে হচ্ছে শুভ্রই তার একমাত্র অবলম্বন । সবসময় তাকে একটা দুঃশ্চিন্তা তাড়া করে বেড়ায় । যদি শুভ্র হারিয়ে যায়? যদি ওকে ভুলে যায় ? হয়তাে নিজের সমস্তটা উজাড় করে দিয়ে শুভ্রকে ভালবাসে আর তাই তাে হারানাের এত ভয় ওর।

অর্নিকা: শুভ্র, কথা দাও তুমি আমাকে কখনও ছেড়ে যাবে না, কথা দাও । কোনদিনও আমাকে ভুলে যাবে না?

শুভ্র: কথা দিলাম অর্নিকা । তুমিও আমাকে কথা দাও ।

অর্নিকা: হু।

অর্নিকার দুচোখ দিয়ে শ্রাবণ বেগে জল নামছিল। শুভ্র ওর হাত বাড়িয়ে ওর প্রতি ফোটা চোখের জল হাতে রাখছিল, যেন মাটিতে না পড়ে।

শুভ্র: পাগলি একটা।

অর্নিকা: হু।

কদিন পরেই এশিয়া কাপ ক্রিকেট ম্যাচ শুরু হবে। ক্রিকেট ভক্ত শুভ্র তাই বেশ উত্তেজিত। সবার সাথে বড় পর্দায় খেলা দেখার চিন্তায় ওর রাতে ঘুমই ধরে না। আজকাল লেখাপড়ার দিকেও তেমন একটা মন নেই। ক্লাস শেষে অর্নিকার কাছে থেকে লাইব্রেরিতে বসে পড়া বুঝে নেয় শুভ্র।

প্রথম যে দিন খেলা শুরু হল, সেদিন প্রথম ম্যাচটা ছিল বাংলাদেশ আর পাকিস্তানের। তাই উত্তেজনাটা সবার মধ্যে অনেক বেশিই ছিল।

শুভ্র: আজ আমরাই জিতব।

জয়: হ্যা আমরা জিতবই।

শুভ্রঃ ইশ ইক্যাচটা যদি মিস না করত তাহলে আরও ভাল করতে পারতাম ।

জয়: হা, কি আর করার ।

পাকিস্তানের একটা উইকেট পরাতে পুরাে হল রুম চিৎকার করে উল্লাসে ফেটে উঠল। 

শুভ্র: ইয়েস, ইয়েস, ইয়েস

দেখেছাে বাবা, আমি বলিনি, আমরাই জিতব? বলেই পাশ ফিরিয়ে বাবার দিকে তাকালাে শুদ্র।

কিন্তু বাবা কোথায়? বাবাতাে নেই।

আশেপাশে বাবাকে খোঁজে শুভ্র। মরিচীকাও হয়তাে দেখা দেয় খানিক পরপর । কিন্তু বাবা একেবারেই তাে হারিয়ে গেছে। বাবার কথা মনে করে শুভ্রর মন খুব খারাপ হয়ে যায়। বাবার সাথে খেলা দেখার সেই মুহূর্তগুলোর কথা মনে পড়ে যায় ওর। ওর মনে হল, বাবা বলে একবার চিৎকার করে ডাকবে। কিন্তু তা সে পারে না।

পুরাে হল রুমে যখন চরম উত্তেজনা আর আনন্দ ঠিক সেই মুহূর্তে একটা ছেলের এই অবস্থা কারও চোখে পড়ে না। কিছুক্ষণ পরে উঠে নিঃশব্দে হেঁটে হল রুম থেকে বের হয়ে যায় শুভ্র । পেছন থেকে অনেকগুলাে কষ্ঠ ওকে ডাকতে থাকে, “শুভ্র, এই শুভ্র কোথায় যাস?

শুভ্র কোন কথার উত্তর দেয় না, কারণ সে নিজেই জানে না যে সে কোথায় যাচ্ছে। রুমে এসে একা একা মুখে বালিশ চেপে কান্না করে শুভ্র। বেশ কয়েকবার ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় চিৎকার করে ডেকে ওঠে, বাবা, বাবা।

ওর সেই ডাক ঘরের মধ্যে শুধু প্রতিধবনি হয়ে ফিরে আসে।

পরদিন সকাল বেলা এনাটমি ক্লাস । পরপর দুইটা আইটেম পেনডিং রয়েছে শুভ্রর । অর্নিকারও একটা। ওরা দুজন সহ আরও কয়েকজন স্যারের কাছে গেল। স্যার শুভ্রকে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছেন ।

শুভ্রও বলে যাচ্ছে তার নিজের মত ।বলতে বলতে থেমে যায় শুভ্র । কিছুতেই উত্তরটা মনে করতে পারছিলনা। চোখ বাঁকা করে অর্নিকার দিকে তাকালাে। কিন্তু অনিকাও চুপ। স্যারের সামনে কিছু বলতে পারছে না। স্যারও এই সুযােগে শুভ্রকে কিছু কড়া কথা শুনিয়ে দিলেন । একে তাে পরীক্ষায় দেরি করে আসে, তার উপর পড়াশুনায় অনিয়মিত হওয়ায় স্যার শুভ্রকে সেদিন সবার সামনে বকা দিলেন ।

স্যারের রুম থেকে বের হয়ে এসে শুভ্র যখন দ্রুত বেগে হাঁটা শুরু করল ঠিক তখনই পেছন থেকে অর্নিকা ওকে থামিয়ে দেয়।

অর্নিকা: তুমি কি আমার উপর মাইন্ড করেছ!

শুভ্র: না, মাইন্ড করব কেন? আমি মাইন্ড করিনি ।

কড়া ভাষায় শুভ্রর কথাগুলাে শুনে অনিকার বুঝতে বাকি রইল না যে শুভ্র কি পরিমাণ রেগে আছে।

অর্নিকা: আমি কিভাবে তােমাকে বলে দিব বল? স্যারের কথায় আমিও খুব কষ্ট পেয়েছি । স্যার তােমাকে অনেক পছন্দ করেন কিনা!

স্যার শুভ্রকে অনেক পছন্দ করতেন । ওর খবর নিতেন সবসময়। যদি কোন দিন ক্লাসে শুভ্র না আসে সেদিন অর্নিকার কাছে শুভ্রর খবর নিতেন। স্যার ওদের ব্যাপারটা জানতেন । শুভ্রও স্যারকে খুব পছন্দ করত।

দেখতে দেখতে আরও একটি কার্ড পরীক্ষা এসে গেল । বিকাল থেকে রাত পর্যন্ত লাইব্রেরিতে বসে পড়াশুনা করে শুভ্র আর অনিকা। পড়ার ফাঁকে ফাকে শুভ্র অর্নিকার কলম নিয়ে ওর হাতে দাগ দেয়। অর্নিকা এতে বিরক্ত হলেও শুভ্রর ছেলেমানুষিকতাকে কিছু বলে না ।

আগামীকাল পরীক্ষা। রাতে পড়াশুনা করে শুভ্র অনিকাকে ফোন দেয় । অনিকা ওকে শেষবারের মত মনে করিয়ে দেয় যে , কাল পরীক্ষা এবং সে প্রতিজ্ঞা করেছে যে এবার পরীক্ষায় দেরি করবে না । শুভ্রও ওকে বলে- হু মনে আছে। ফোন রেখে দিয়ে পাশে তাকিয়ে দেখে জাহিদ অঘােরে ঘুমাচ্ছে ।

ঘড়িতে রাত ১ টা। বিছানা থেকে লাফ দিয়ে নেমে হঠাৎ জাহিদ ডেকে তােলে । আর জাহিদ কিছুক্ষণ হলাে ঘুমিয়েছে ওর কাচা ঘুমটা ভেঙে দেওয়াতে ও খুব রেগে গেল ।

জাহিদ: কি হয়েছে? ঘুমাতে দিবি না?

শুভ্র: আরে ওঠ না, চল কার্ড খেলব জাহিদের ঘুমটা তখন ও ভাঙেনি। কার্ড খােলার কথা শুনে চোখটা ভালভাবে ঘষে শুভ্রর দিকে বড় বড় চোখ করে তাকালাে ।

জাহিদ; তাের মাথা খারাপ? কাল পরীক্ষা না? সকালে উঠতে হবে না? 

শুভ্র: বেশি না দোস্ত, শুধু একবার। শুদ্র জাহিদকে এমনভাবে জোর করতে লাগল যে জাহিদ শতবার না করলেও ওর কথা শুনতে চাইছে না। অবশেষে জাহিদ রাজী হয়ে গেল।

জাহিদ: মনে থাকে যেন।

কারণ জাহিদ জানে অন্যথায় শুভ্র ওকে ঘুমাতে দেবে না। কার্ড খেলতে খেলকে কখন যে রাত ৪ টা বেজেছে কারও খেয়াল নেই। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে হাতের কার্ডটা ফেলে দিয়ে জাহিদ এক দৌড়ে ওর বেড়ে গিয়ে ঘুমায়ে পড়ে ।

জাহিদ: কাল যদি পরীক্ষা মিস হয় তাহলে বুঝবি। আমাকে ডেকে দিস কিন্তু । টেবিল ক্লকে এলার্মটা দিয়ে রাখিস । আমি ঘুমালাম ।

ঘড়িতে এলার্ম দিয়ে শুভ্রও ঘুমিয়ে পড়ে। একবার ভাবলাে অনিকাকে ফোন করবে । কিন্তু কি দরকার ওর ঘুমটা নষ্ট করার । প্রিয় মানুষটার সুখেই মানুষ সবচেয়ে বেশি খুশি হয়। অর্নিকার কথা মনে মনে ভাবতে ভাবতে শুভ্র ঘুমিয়ে পড়ে ।

পরদিন সকালে ঘড়ির এলার্ম শুনে জাহিদের ঘুম ভাঙে। উঠে দেখে শুভ্র নাই । হয়তাে এবারও বাইরে গেছে । তাড়াতাড়ি করে রেডি হয়ে চলে যায় ও অর্নিকাও শুভ্রকে ফোন দেয়। কিন্তু ফোন বন্ধ ।

জাহিদ আর অনিকা যখন হল রুমে পৌছালাে তখন পরীক্ষা শুরু হতে আরও দুতিন মিনিট বাকি। ওদেরকে অবাক করে দিয়ে শুভ্র আগেই এসে হাজির। শুভ্রকে দেখে অনিকা খুশিই হল। আর জাহিদও মনে মনে ভাবলাে, “যাক সূর্য তাহলে এবার পশ্চিম দিকেই উঠল।”

শুভ্রকে দেখে অর্নিকা একটা মুচকি হাসি দিল। শুভ্রও অর্নিকাকে দেখে এমন একটা অঙ্গভঙ্গি করল যেন কিছুই হয় নি ।

পরীক্ষা শেষ হলাে, তাতে কি? কয় দিন পর আবার একটি পরীক্ষা। তাই বাধ্য হয়ে পড়াশুনাটা চালিয়ে যেতে হল শুভ্রকে অর্নিকার সাথে লাইব্রেরিতে। আজকাল অর্নিকার অনুরােধে শুভ্র পড়াশুনায় আগের চেয়ে বেশি মনােযােগী হয়েছে। মাঝে মাঝে শুভ্রর উদ্ভট সব কাজকর্ম অনিকাকে উদ্বিগ্ন করে ঠিকই। কিন্তু এর জন্য সে মন খারাপ করে না। কারণ সে জানে ভালবাসায় কষ্ট না পেলে সে ভালবাসা খাঁটি হয় । অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কয়েকদিন পর ওদেরকে আবার পরীক্ষায় বসতে হল। যথারীতি আগের ঘটনার পূনরাবৃত্তি । জাহিদ, অর্নিকা কেউই শুভ্রকে খুঁজে পায় না। এদিকে ঘড়িতে সময় হয়ে যাচ্ছে। শুভ্র তখনও আসেনি। স্যার সবার হাতে প্রশ্ন দেওয়া মাত্রই সবাই লেখা শুরু করেছে। প্রশ্ন হাতে অর্নিকা তখনও শুভ্রর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে। ডানে বামে সামনে পেছনে তাকাচ্ছে শুধু ও।

কখন শুভ্র আসবে। দেখতে দেখতে বিশ মিনিট কেটে গেল । অনিকা তখন পর্যন্ত একটা অক্ষরও লেখেনি। ত্রিশ মিনিট কেটে গেল কিন্তু শুভ্র তখনও আসে না। অনিকার তখন বুঝতে বাকি রইল না যে, শুভ্র আজ আর আসবে না। হঠাৎ সিট থেকে উঠে দাঁড়ালাে ও।

অর্নিকা: স্যার, আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে । স্যার আমি পরীক্ষা দিতে পারব । মাথাটা ঘুরছে । স্যার আমি চলে যাব ।

স্যার: বল কি? পরীক্ষা দিতে হবে না?

অর্নিকা: সরি স্যার । আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না।

স্যার: ওকে, ওকে যাও, তােমার সাথে কাউকে পাঠাবাে?

অর্নিকা: না স্যার, আমি একাই যেতে পারব।

এভাবে স্যারের সাথে মিথ্যা কথা বলে, অসুস্থতার অভিনয় করে ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে হল রুম থেকে বের হয়ে গেল অর্নিকা। হলের সবাই এক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে ছিল তখন। তবে অন্য কেউ বুঝুক তার নাই বুঝুক জাহিদ ব্যাপারটা ঠিকই ধরেছে। শুভ্রর প্রতি অর্নিকার এই অকৃত্রিম ভালবাসাকে মনে মনে স্যালুট জানালাে সে।

এতক্ষণ একটা চাপা কান্না বুকের মধ্যে জমা রেখেছিল অর্নিকা। হল রুম থেকে বের হয়েই হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। দৌড় দিয়ে হােস্টেলের দিকে গেল ও । শুভ্রকে সে কতটা ভালবেসেছে সে নিজেও জানে না। একটি পরীক্ষাই তাে! তাতে কি? যার সাথে সারা জীবন থাকার প্রতিজ্ঞা করেছে, তার ভালবাসাকে সম্মান করতেই হয়তাে অর্নিকা আজ এই কাজটি করেছে ।

বিকালে শুভ্র অর্নিকার সাথে কোন ভাবেই যােগাযােগ করতে পারছিল না। বাধ্য হয়ে ওর হােস্টেলের সামনে যায় শুদ্র। রাস্তার পাশেই বিল্ডিং । তিনতলায় অর্নিকার রুম। নিচ থেকে অর্নিকার নাম ধরে নীচু গলায় ডাক দেয়। অনেকক্ষণ পর অর্নিকা জানালা দিয়ে উকি দিয়ে নিচে তাকিয়ে শুভ্রকে দেখতে পেল । অনিকা রেগে টমেটোর মত লাল হয়ে আছে।

নীচ থেকে শুভ্র ওকে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে সরি বলছে। কান ধরে এদিক ওদিক তাকিয়ে ওঠাবসা করছে, কিন্তু অর্নিকা কথা বলে না। খটাশ করে জানালাটা বন্ধ করে দিল অনিকা। ভাবল শুভ্রর সাথে আজ কিছুতেই কথা বলবে না। কিন্তু না, অনিকা পারে না । শুভ্রর ভালােবাসার কাছে অর্নিকা হার মানে। চোখের জল মুছতে মুছতে সিড়ি দিয়ে নিচে নেমে আসে। শুভ্রকে দেখে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে জড়িয়ে ধরে অর্নিকা । শুভ্রর ছেলেমানুষি তখনও যায় না ।

পকেট থেকে একটা ললিপপ বের করে অর্নিকার মুখে ধরে বলে ।

‘খাও’ ঠিক তখনই অর্নিকাও শুভ্রর এই পাগলামি দেখে না হেসে পারে না।

অর্নিকা: চল

শুভ্র: এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতাে তুমি বলতাে?

অর্নিকা: তুমিই বল

শুভ্র: না, তুমিই বল

অর্নিকা: পাগল একটা!

দিন যায়, দেখতে দেখতে প্রফেশনাল পরীক্ষাও এসে যায়। পড়াশুনার চাপ যেমন বাড়তে থাকে ঠিক তেমনি শুভ্র ও অর্নিকার ভালবাসার গভীরতাও বাড়তে থাকে সমানুপাতিক হারে। প্রফেশনাল পরীক্ষা শেষ করে সবাই বাসায় চলে যাচ্ছে । অর্নিকাও শুভ্রর কাছ থেকে বিদায় নেয়। শুভ্রকে ছাড়া থাকতে হবে অনেক দিন একথা ভাবতেই অর্নিকার মনটা খারাপ হয়ে গেল । যাবার দিন অর্নিকাকে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত এগিয়ে দিল শুভ্র।

বাসে অনিকাকে তুলে দিয়ে শুভ্রও হাত নেড়ে অর্নিকাকে বিদায় জানালাে। দূর থেকে কেউ কারও কথা শুনতে না পেলেও ওদের কাঁপা কাঁপা ঠোট আর অশ্রুসিক্ত চোখ বলে দিচ্ছিল ভালবাসার মানুষকে ছেড়ে থাকাটা কতটা কষ্টের ।

দুইমাস পর প্রফেশনাল পরীক্ষার রেজাল্ট বের হল। রেজাল্ট হাতে পেয়েই শুভ্র অর্নিকাকে ফোন করল। ওরা দুজনেই ভালভাবে পাশ করেছে । মজার ব্যাপার হল শুভ্র অনার্স মার্ক পেয়েছে। পড়াশুনায় অর্নিকা যদিও শুভ্রর চেয়ে রেগুলার ছিল ।

নতুন বছরে নতুন ক্লাসে ওরা একসাথে নতুন করে জীবন শুরু করল । দেখতে দেখতে আরও দুইটি বছর কেটে যায়। সেদিন সকালে গাইনী ওয়ার্ডে ক্লাসে শুভ্র অনিকাকে দেখে মুচকি হাসে। হেসেই যাচ্ছে । অনিকা কিছুই বুঝলাে না। ক্লাস শেষে অর্নিকা রেগে যেয়ে শুভ্রকে ওর হাসির কারণ জানতে চাইল। তখন শুভ্র অনিকাকে বলল- জানাে, অর্নিকা, তােমাকে আজ না, ঠিক গাইনী ডাক্তার লাগছিল’ অর্নিকা কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু পেছন থেকে ওর বান্ধবি ডাক দেওয়াতে ও চলে যায়। যেতে যেতে বলে- এটা কিন্তু ঠিক হলাে না।

অনিকাকে মাঝে মাঝেই গাইনী ডাক্তার বলে শুভ্র ওকে খেপায় । কারণে অকারণে গাইনী ডাক্তার বলায় অর্নিকা মাঝে মাঝেই রাগ করত যদিও ওর ইচ্ছাও ছিল গাইনী ডাক্তার হওয়ার। 


যতই দিন যেতে থাকে ক্লাস আর ওয়ার্ডের প্রতি শুভ্রর আকর্ষন ততই কমতে থাকে। অন্যান্য ক্লাস করলেও কার্ডিওলজি বিভাগে একেবারেই যায় না। স্যার ওকে অনেক বুঝানাের পরও কোন কাজ হয়নি। প্রথম প্রথম দুচারদিন ক্লাস করেছে। তার পর উধাও। আবার অনেকদিন পর একদিন ।

সি সি ইউ রুমে যখন ক্লাসে সবাইকে স্যার বুঝান তখন শুভ্রর মনটা ক্লাসে থাকে না । ওকে অনেক বিমর্ষ লাগে । আতঙ্কিত মনে হয় । সবাই যখন স্যারকে ঘিরে স্যারের কথা শুনতে থাকে তখন শুভ্র স্যারের কাছে থেকে দূরে দূরে থাকে। মাথা নিচু করে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। মন খারাপ করে থাকে। রাউন্ড দিতে দিতে স্যার যখন ঠিক দরজার বামপাশের রােগীর বেডের কাছে আসেন, ঠিক তখনই শুভ্র সবার অলক্ষে রুমের পেছনে গা ঢাকা দেয় । অনিকা ওকে সব সময় চোখে চোখে রাখে ।

ক্লাস শেষে স্যার যখন বাহিরে চলে গেলেন তখন অনিকা শুভ্রকে আবিষ্কার করে রুমের বিপরীতে চেয়ারে বসে দুহাত দিয়ে মুখ ঢেকে রেখেছে। ওদিকে দরজা না থাকায় বেচারা পালাতে পারে নি।

অর্নিকা: শুভ্র কি হয়েছে? এভাবে চলে এলে কেন?

শুভ্রর মুখের দিকে তাকিয়ে অর্নিকা বুঝতে পারল যে কিছু একটা হয়েছে যার জন্য ওর মনটা খুব খারাপ। চেয়ার থেকে উঠে অর্নিকার দিকে তাকিয়ে একটা শান হাসি দিয়ে শুভ্র চলে গেল । কোন কথা বলল না।

“এই যা! আউটডােরে স্যারের কাছে যাব, মনেই নেই”।

বলতে বলতে এপ্রনের পকেট থেকে দশ টাকার বিনামূল্যে পাওয়া টিকিটটা বের করছিল জাহিদ। ঘড়িতে তখন রাত আটটা বাজে। এমন সময় জাহিদের ফোনটা বেজে উঠল ।

জাহিদ: হ্যালাে, বাবা, কেমন আছ? আমি ভাল আছি। সামনে আমার পরীক্ষা, জানাে বাবা, আজ না, হার্ট এটাকের এক রােগীকে আমরা ট্রিটমেন্ট করেছি। বেচে গেছে। আল্লাহ বাঁচাইছেন।

ফোনে অনর্গল কথা বলেই যাচ্ছে জাহিদ। শুভ্র তখন পত্রিকা পড়ছিল। জাহিদের কথাগুলাে ওর কানে বাজছিল। হঠাৎ করেই রুম থেকে বের হয়ে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠে ছাদের উপর চলে গেল। অনিকাকে একটা ফোন দিল। ওপাশ থেকে অর্নিকা হ্যালাে হ্যালাে বলছিল, কিন্তু শুভ্র কোন কথা বলতে পারছিল না। ওর চোখে অশ্রু ঝরছিল নিজেকে সামলে বারবার চেষ্টা করছিল কথা বলতে কিন্তু পারল না। ফোনটা কেটে দিল । পরে অর্নিকা ফোন করবে ভেবে ফোনের সুইচটা অফ করে রাখে। 

একে তাে সিসি ইউতে ক্লাসের সময় বাবার মৃত্যুর দৃশ্য ওর চোখে ভেসে ওঠে, তারপর জাহিদের বাবার কথা শুনে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারে নি । ও চাপা দুঃখ কষ্ট বুকে রেখেছে । সামান্য হালকা করার জন্য অনিকাকে ফোন দিলেও ওকে কিছুই বলতে পারেনি শুভ্র । বাবা শূন্য এই পৃথিবীতে নিজেকে ওর বড় অসহায় লাগে। তাই বুক ফাটা আর্তনাদ করে খােলা আকাশের নিচে বাবা বলে চিৎকার করে ওঠে।

বেশ কয়েকটা পরীক্ষা মিস করে শুভ্র এরই মধ্যে। আর কার্ডিওলজি পরীক্ষা সে কখনই দেয় না। এজন্য স্যার ওর উপর রেগে আছেন ।

একদিন পরীক্ষার পর সি সি ইউ রুমে স্যার ক্লাস নিচ্ছিলেন। রােল কল করার সময় তিনি শুভ্রকে দাঁড় করিয়ে রাখলেন। তারপর ওর অনুপস্থিতির কারণ জিজ্ঞাসা করলেন । শুভ্র স্যারের কোন কথার জবাব দিচ্ছিল না। শুভ্রর কোন কথার জবাব না পেয়ে স্যারও রেগে যাচ্ছিলেন।

স্যার: পেয়েছ কি তুমি? ইচ্ছামত ক্লাসে আসবে? একটি পরীক্ষাও তুমি দাওনি? কেন? জবাব দাও?

শুভ্র তখনও মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে । স্যার ওকে মাথা তুলে তাকাতে বললেন। তারপরও কিছু বলছে না শুভ্র । ওর দুচোখ ছলছল করছিল । হঠাৎ করে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । তার এই আচমকা কান্না দেখে সবাই অবাক হয়ে গেল।

শুভ্র: স্যার আমি কেন এই ক্লাসে আসি না শুনতে চান?

স্যার: হ্যা বল ।

শুভ্র তখন স্যারের হাতটা ধরে টেনে দরজার বামপাশের বেড়টির কাছে নিয়ে গেল ।

শুভ্র: স্যার ভাল করে দেখুন, এই বেডটা, এই বেডটাতে আমার বাবা মারা যান আজ থেকে ৬ বছর আগে। আমি যখন এই ক্লাসে আসি তখন আমার বাবার সেই স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। আমি নিজেকে আর ধরে রাখতে পারি না তখন। আর এই জন্যই ক্লাসে আসি না। বাবার মুখটা ভেসে ওঠে। জানেন স্যার, এই বেডটাতে শুয়েই বাবা মারা যাওয়ার আগে আমাকে কিছু কথা বলে যেতে চেয়েছিলেন, কিন্তু পারেননি ।

স্যার: তাই বলে তুমি পরীক্ষা মিস দেবে?

শুভ্র: স্যার আমি কখনও পরীক্ষা মিস দিতে চাইনি। আমার বাবার ইচ্ছা ছিল আমাকে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াবে, কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর আমি মেডিকেলে ভর্তি হয়েছি। পরীক্ষার দিন সকাল বেলা তাই আমি বাবার কবরে যেয়ে বাবার কাছে ক্ষমা চাই। এখন আমি বাবার ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারি নি। আর বাবার কাছে ক্ষমা চেয়ে আসতে দেরী হওয়াতে পরীক্ষা দিতে পারি না।

শুভ্রর কান্না ঝরানাে কথাগুলাে সবাই খুব মনােযােগ দিয়ে শুনছে। সবার চোখে জল এসেছে। আর অর্নিকাও শুভ্রর এই ব্যাপারটা জানত না। অর্নিকাও ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে।

শুভ্র তখন অর্নিকার কাছে এসে বলল- সরি অর্নিকা, আমাকে মাফ করে দিও। আমার জন্য তােমারও অনেকগুলাে পরীক্ষা দেয়া হয় নি।

স্যার তার চোখের পানি মুছে, শুভ্রর কাছে এসে দুহাত দিয়ে ওর চোখের পানি মুছে দিলেন। তারপর ওকে সান্ত্বনা দিলেন ।

শুভ্র: আমি বাবার ইচ্ছাটা পূরণ করতে পারিনি স্যার।

স্যার: তুমি পেরেছ শুভ্র, তুমি অবশ্যই পেরেছ । মারা যাওয়ার আগে তােমার বাবা হয়তাে তােমাকে একথাই বলতে চেয়েছিল যে, যদি সুযােগ থাকতাে তাহলে শুভ্রকে ডাক্তারিতে ভর্তি করাতেন। সেদিন তােমার বাবা এখানে মারা গেছেন, আজ প্রতিজ্ঞা কর, যে তুমি ভাল ডাক্তার হয়ে সবাইকে সেবা দেবে । আর কোন রােগী যেন তােমার বাবার মত মারা না যায় এবং আমি জানি তুমি পারবে শুদ্র। আমরা সবাই সেই দিনের অপেক্ষাতেই থাকব।

স্যার শেষে শুভ্রকে বুকে টেনে নিলেন । পুরাে সি সি ইউ রুমে এতক্ষণ চরম নিস্তদ্ধতা বিরাজ করছিল। সেদিনের মত স্যার ক্লাস থেকে চলে এলেন ।

কয়েক বছর পর,..

হ্যাঁ অর্নিকা, আমার আর ঘণ্টাখানেক দেরী হবে, তুমি ড্রাইভারকে বলে দাও বাবুকে স্কুল থেকে আনতে।

এভাবেই ফোনে কথাগুলাে বলছিল ডা: শুভ্র, সহকারী অধ্যাপক, কার্ডিওলজি বিভাগ। অনিকাও আজ একজন বড় গাইনী ডাক্তার। একই হসপিটালেই দুজন চাকরি করে। শুভ্র তার মেধা ও যােগ্যতার বলে আজ শহরের একজন সেরা কার্ডিওলজি হয়েছে। সি সি ইউ রুমে ঢুকতে আজ আর সে ভয় পায় না।

ঠিক সেই বেড থেকেই রােগী দেখা শুরু করে যে ৰেড়ে তার বাবা মারা গিয়েছিলেন। নিজে না পারলে, নিজের টাকা খরচ করে হলেও সে রােগীদের ট্রিটমেন্ট করে । কারণ সে জানে বাবা হারানাে বেদনাটা কেমন । ফোনটা আবার বেজে উঠল । পকেট থেকে ফোনটা বের করে কানে ধরে বলল- হ্যা, অর্নিকা, আমি নিচে নামছি।

এ রকম অসংখ্য অগণিত শুভ্র হয়তাে বাস্তবে পাওয়া যাবে, যাদের পাশে থাকে অনিকার মত একজন ভাল জীবনসঙ্গী। সময়তাে থেমে থাকে না। শুভ্রর পরবর্তী প্রজন্ম ওকে কি উপহার দেয় আমরা সেই অপেক্ষাতেই থাকবাে।

৩১ মার্চ ২০১৪
১২

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.