একজন রনক,মিছির আলী ও হুমায়ুন আহমেদ (আহসানুল হক আশিক) ছোট গল্প।
বন্দর থেকে কিলাে ২ দূরে.
হবে । আঁকাবাঁকা পথ চলে গেছে গ্রামের দিকে। শান্ত, সবুজ গ্রাম। এই গ্রামেই
থাকে রনক ও তার পরিবার। তার বয়স ১০। বড় বোন রণিতা, বাবা, মা ও দাদুকে
নিয়ে তাদের ছােট্ট সংসার। বড় বােন এবার এসএসসি পরীক্ষার্থী। বাবা একটা
অফিসে চাকরি করেন। পাশাপাশি বাড়ির জমি জিরাত ও দেখাশুনা করেন। বুড়াে
বাপকে নিষেধ করা সত্ত্বেও মাঠে কাজ করতে যায়। আর বাড়ির লক্ষ্মী গিন্নী,
উনার কাজ হল রান্নাবান্না করা আর বাড়ির কাজের পাশাপাশি বাড়ির লােকদের
যত্নআপত্তি করা ।
রনক এবার পিএসপি পরীক্ষা দেবে। বাড়িতে মা পড়তে দিয়ে
বাসার কাজ করেন। তখনবুড়াে শ্বশুরকে ছেলের পাশে বসিয়ে দিয়ে যান । দাদু
বলে কথা। দুজনের মধ্যে গলায় গলায় মিল। আবার সারাদিন দুজনের মধ্যে
ঠোকাঠুকি লেগেই আছে । দুজনে এক জায়গায় হলেই পৃথিবীর সকল প্রকার বস্তু
নিয়ে যুক্তিতর্কে মেতে ওঠে। তখন পাশ থেকে গিন্নী বলে ওঠে- আবার শুরু হল?
এরপর কিছুক্ষণ নিরবতা, অত:পর খুনসুটি, এবং তারপর আবার...
রনকের একটা বড়
গুণ আছে, আর তা হল বই পড়া। তার বড় বােন যখন হাইস্কুলে। ওঠে, তখন থেকে বই
পড়া শুরু করে ।বােন যখন স্কুলে যায় তখন তার টেবিল থেকে বই নিয়ে চুরি করে
পড়ে। বই পড়াটা তার এতটাই নেশা হয়ে গিয়েছিল যে মাঝে মাঝে যখন স্কুল
বন্ধ থাকত,তখন বােনের একটা বই নিয়ে সকাল বেলা বাড়ি থেকে রওনা দিত ।
বড়
বিলটার পাড়ে পাহারা দেওয়ার জন্য যে ছােট্ট কুঁড়েঘরটি আছে, সেখানে এক
বসাতেই একটা বই শেষ করে ফেলে। বিকাল গড়িয়ে এলে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশের
দিকে হেলে পড়ে তখন বাড়ির দিকে রওনা দেয় ।
বাড়ির দরজার কাছে টু মেরে
দেখে কে কোথায় আছে। তারপর অতি সন্তর্পনে পা টিপে টিপে ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ
করে বিছানায় শুয়ে পড়ে ।আর কিছুক্ষণ পরে মা এসে কান ধরে হাতের খুনতি
দিয়ে এলােপাথারি মারতে থাকে।
সারাদিন কোথাই ছিলি? বল হতভাগা? আগে বল কোথাই
ছিলি?
বলছি বলছি-
আপুর একটা বই নিয়ে বাইরে বিলের ধারে পড়তে গেছিলাম।
একথা শুনে মা খানিকটা থ বনে গেলেন। তারপর একটু কি যেন ভেবে আবার মারা শুরু
করলেন।
বলি , নিজের পড়ার খবর
নাই, গল্পের বই পড় না?
ঠিক তখনই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে বড় বােন রণিতা বলে
উঠল-
তাইতাে লাইব্রেরির বইটা খুঁজে পাচ্ছিলাম না মা?
কিছুক্ষণ উত্তম মাধ্যম
খাওয়ার পর এবার মা রনককে খেতে ডাকলেন।
একে তাে ভর সাঁঝবেলা, তার ওপর
সারাদিন কিছুই খাওয়া হয়নি। তাই খানিকটা অনিয়ম করেই খেতে বসে সে। ডাল,
মাংস দিয়ে কখন যে তিন প্লেট ভাত সাবার করল সে নিজেও জানে না। খাওয়া শেষে
ঘরে যাওয়ার সময় বুড়ো দাদুর সাথে দেখা হয় । ওরে বাবা! বুড়াে দাদুও ওকে
দেখে পেছনের দিকে মুখ ঘুরায় ।
দাদু: তুমিও! ঠিক আছে আমিও দেখব। আমার ও দিন
আসবে। এই বলে রাখলাম । ঘরে যেয়ে বিছানার উপর দরাম করে শুয়ে পড়ল। ওর
শােয়ার শব্দে পাশের ঘর থেকে মা পর্যন্ত চমকে ওঠেন। ঘণ্টা দুএক পরে ওঠে
পড়তে বসে ।
মা দাদু কোথায়- তাের দাদু একটু বাইরে গেছেন।
কোথায়?
এতকথা
বলিস কেন? পড় বলছ
সন্ধ্যার রাগটা যে মায়ের এখনও কমে নি এটা সে ভালভাবেই
বুঝতে পারল। চারপাশে একবার বিজ্ঞের মত তাকিয়ে আবার পড়া শুরু করল- “দুখু
আর সুখু দুই বােন'।
রাতে পড়াশুনা শেষ করে দুজনে শুতে গেল।
আপু দাদু কোথাই
গেছে রে,জানিস?
ও পাড়াতে একটু গেছে ।
কখন আসবে?
জানিনা, ঘুমা?
কিছুক্ষণ
ভান করে শুয়ে থাকে। আবার ওঠে জিজ্ঞাসা করে ।
কি বই পড়িস আপু।
কিছু না,
ঘুমা বলছি!!
আপুর হাতের বইটা হঠাৎ কেড়ে নিয়ে নাম দেখে “আমি মিসির আলী ।"
দে পাজি ছেলে, মাকে কিন্তু বলে দেব বলছি।
ধর
এই বলে বিছানায় শুয়ে পড়ে চোখ
বন্ধ করে ঘুমের ভান করে পড়ে থাকে। তখন একটা কথাই মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে।
কখন বইটা পড়বে। কখন আপু ঘুমাবে। হঠাৎ বুঝতে পারে আপু শুয়ে পড়েছে ।
তারপর
যখন রনক বুঝল যে সে ঘুমিয়ে পড়েছে তখন এ পাশ ঘুরে ভাল করে দেখে ।
দেখে
আপু বইটা বুকের কাছে নিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে । আস্তে করে বইটা টান দিয়ে পড়া
শুরু করে আর আপুকে মনে মনে ধন্যবাদ দেয়।
কিছুক্ষণ পর ঘরের দরজাটা খুলে
যায় । তাড়াহুড়াে করে ও ঘুমিয়ে পড়ে বইটা পাশে রেখে।
লাইটটা অফ করে ঘুমিয়ে
পড়লেই তাে পারতিস? ভারি গলায় ওর দাদু বলে ওঠল রনক তখন বুঝতে পারে যে দাদু
ওর চালাকিটা বুঝতে পেরেছে । কিন্তু তখনও চোখ খােলে নি।
আমি জানি তুই আমার
ওপর মন খারাপ করেছিস। আজ সারাদিন আমি একা ছিলাম । শােন একটা নতুন বাটুল
বানিয়েছি, নিবি?
যেই না বাটুলের কথা শুনেছে,অমনি এক লাফে বিছানা থেকে ওঠে
বসেছে রনক । বাটুল কোথায়? এক্ষুণি দাও ।
না আজ আর নয়। কাল দেব। এখন ঘুমা।
এভাবে একটা বাটুলের মাধ্যমেই দাদু আর নাতির মান অভিমান সে দিনের মত ভেঙ্গে
গেল। সে দিন আর বই পড়া হল না। ঘুমিয়ে পড়ল ।
পরদিন, সে তার ক্লাসের
বন্ধুদের তার পড়া বই সম্পর্কে বলল । ওরা শুধু হা করে তাকিয়ে ওর কথা শুনে ।
মনে হয় যেন রনক ওদের কেচ্ছা শোনাচ্ছে। কিন্তু ওরা কতটুকু বুঝল সেটার
তােয়াক্কা না করে রনক শুধু বলেই যায়, থামে না।
বিকেলে স্কুল থেকে বাড়িতে
আসার পর দাদুর কাছে বাটুল চায়। দাদু ওনার তােষকের নিচ হতে ওটা বের করে
দেয় । রনক আনন্দে চিৎকার করে ওঠে । ঠিক তখনই দাদু ওর মুখ চেপে ধরে ।
থাম
তোর মা শুনলে খবর আছে।
পিএসসি পরীক্ষা ভালভাবেই শেষ করে রনক । একে একে
ষষ্ঠ, সপ্তম, অষ্টম করে নবম শ্রেণিতে ওঠে সে । আর এরই মধ্যে সে অনেকগুলাে
বই পড়ে ফেলে । কৈশরেই এই ছেলেটি নিজের মধ্যে একটা মননশীল সাহিত্য জগতের
সাথে বাস করতে থাকে। কখনও অপু, কখনও ফটিক কখনও শ্রীকান্ত আবার কখনও অমিত
রায় । একটার পর একটা বই শেষ করে বাসায় বইয়ের একটা বিরাট লাইব্রেরী গড়ে
তােলে।
তবে তার কাছে হুমায়ূন আহমেদ এর বই এতটাই ভাল লেগেছে যে, সে এখন
পর্যন্ত উনার অনেকগুলাে বই পড়েছে ।
তার
এক একটা বই যখন শেষ করেছে তখন জগৎ সংসার প্রেম ভালবাসা আর বিরহ বেদনা তার
ছােট্ট হৃদয়ে অনেকটাই দখল করে নিয়েছে।
সে সব সময় ভাবত, যদি এরকম এতবড়
একটা লােকের সাথে দেখা করতে পাড়তাম।
বড় আপু এবার ঢাকা ভার্সিটিতে ভর্তি হল। আপুর
কাছে শুনেছে তিনি নাকি ঢাকাতেই থাকেন। কোন দিন যদি আপুর সাথে ঢাকায় আসে
তাহলে হুমায়ূন আহমেদকে দেখার সুযােগ হাতছাড়া করবে না। রনক । মাঝে মাঝে
বড় আপু তাকে ঢাকা থেকে বই পাঠিয়ে দেয় তাকে পড়ার জন্য । পিএসসি ও জেএসসি
পরীক্ষায় জিপিএ ৫.০০ পাওয়ার পরও তার এরকম আনন্দ হয়নি। যতটা আনন্দ হয়
তার হুমায়ূন আহমেদের বই হাতে পেলে।
এই তাে সে দিন উনার “এবং হিমু” বইটা
শেষ করল, তার কয়েকদিন পরেই “হিমুর রূপালি জোৎস্যা”, “আমি মিসির আলী”, এরকম
একটার পর একটা বই শেষ করে। হুমায়ুন ভক্ত এই পাঠক নিজেকে হিমু ভাবতে শুরু
করে দিনে দিনে। তার আচরণে ধীরে ধীরে হিমু আর মিসির আলীর চরিত্রগুলাে ফুটে
ওঠে। সেবার ঈদে বাবা ওকে পাঞ্জাবী কিনে দিতে চাইলে রনক হলুদ পাঞ্জাবীর কথা
বলে বাবার সাথে জিদ ধরে । জন্ডিস কালারের এই রঙের কথা শুনে সবাই অবাক হয় ।
কিন্তু হিমুরা যে হলুদ পাঞ্জাবি পরে সে কথা হয়ত বাবা মা জানে ।
কিন্তু
বড় আপু ওকে ঠিকই ধরতে পেরেছে কিরে, হিমু হতে চাস না কি? বড় আপুর কথায়
রনক কোন উত্তর দিল না। শুধু একবার তাকিয়ে একটু বাঁকা হাসি দিল। বাবার সাথে
মার্কেটে এসে মহা বিপদে পড়ে রনক । হলুদ পাঞ্জাবি পাওয়া যায় মা। অনেক
চেষ্টা করেও যখন তারা হলুদ রঙের পাঞ্জাবি খুঁজে পাচ্ছিল না তখন বাবা বাধ্য
হয়ে এক দোকানে অন্য রঙের পাঞ্জাবি কিনতে ঢুকে পড়েন। দাম প্রায় ঠিকও হয়ে
গেছে। দোকানদারকে টাকা দিতে যাবে, এমন সময় রনক চিৎকার করে বলে- পাইছি.........
বলেই দোকান থেকে দৌড় দিয়ে পাশের দোকানে যায়। বাবাও ওর পিছু পিছু গিয়ে
দেখে রনক একটা হলুদ পাঞ্জাবি ধরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাবা, আমার এটাই চাই।
কি
আর করা। বাবা পূর্বের দোকানদারকে অনেক বুঝিয়ে অবশেষে রনকের পছন্দের
পাঞ্জাবিটাই কিনে দিলেন। তবে সমস্যাটা হল পাঞ্জাবিটা লম্বায় ওর চেয়ে বড়
ছিল । তাতে কি? হলুদ রঙের হয়েছে এটাই রনকের জন্য যথেষ্ট। খুশিতে লাফাতে
থাকে ও।
বাড়িতে
আসার পথে দর্জিকে দিয়ে পাঞ্জাবিটার ঝুল খাটো করে নেয় । মনে মনে ভাবে,
পাঞ্জাবিটা যদি এখনই পরতে পারতাে! তবে দর্জির সাথে চুপি চুপি রনক কি যেন
বলল, বাবা বুঝতে পারল না।
ঈদের দিন রনক একে একে বাড়ির সবাইকে সালাম করে
সালামির টাকা আদায় করে । দুষ্ট দাদু মজা করে তার নাতিকে একশত একটাকা দেয় ।
এক টাকার কয়েনটা হাত থেকে প্রায়ই মেঝেতে পরে যাচ্ছিল। মা কাছে এসে রনককে
পাঞ্জাবিটার পকেটে টাকা রাখতে বলে।
মা এরা কথা শুনে পাঞ্জাবির পকেটে টাকা
রাখতে যাবে এমন সময় মনে হল, ওর তাে পকেট নেই। তাহলে টাকা কোথায় রাখবে?
কাউকে বুঝতে না দিয়ে প্যান্টের পকেটে টাকাটা রেখে দেয় ।
বড় আপু মনে হয়
ব্যাপারটা বুঝতে পেরেছে । রনককে ঘরে ডেকে নিয়ে গিয়ে ওর পাঞ্জাবির পকেট
খুঁজতে থাকে। যখন দেখে যে পকেট নেই, তখন বড় আপু হেসে গড়াগড়ি খায় মেঝেতে
। মা বাবা এসে কি হয়েছে জানতে চাইলে বলে- বাবা, মা, ওর পাঞ্জাবির পকেট
নাই ।
কি?
অবাক হলেন তারা। বাবা ব্যাপারটা কিছুক্ষণ পরে বুঝতে পারলেন । রনক
দর্জির সাথে কানে কানে কি কি যেন বলছিল । হয়ত তখনই দর্জিকে বলে পকেটটা,
সরিয়েছে । লজ্জা পেয়ে রনক কিছু বলে না, শুধু চুপ করে থাকে। কিন্তু বড়
আপু ছাড়া এই ব্যাপারটি বাবা, মা দাদু কেউ বুঝতে পারল না।
হিমুর প্রতিচ্ছবি
এই রনক হিমুর আচরণ গুলােকে নকল করতে থাকে। আর তাইতাে ক্ষুধা পেলে সে মাকে
খেতে দিতে বলে না । বারান্দায় বসে শিষ দিতে থাকে। তার এই শিষ দেয়াতে মা
যখন বিরক্ত হয়ে ওকে থামতে বলেন,
তখন রনক বলে মা আমার ক্ষুধা পেয়েছে, কখন
থেকে তােমাকে ডাকছি, শুনাে না? কখন ডাকলি ?
দেখছ না আমি শিষ দিচ্ছি , এখন
থেকে আমি শিষ দিলে বুঝবে যে আমার ক্ষুধা পেয়েছে।
ছেলের মাথা খারাপ হল কিনা
এই নিয়ে মহা চিন্তায় পড়লেন মা।
ঠিক আছে খেতে আস।
খাওয়া শেষে মাকে বলে
মিষ্টি পান দিতে। কোনদিন যে ছেলে পান খায়না, আজ কি
এমন হলাে যে, পান খেতে
চাচ্ছে?
মা বললেন, বাবা তাের কি হয়েছে?
আমার কিছু হয় নি মা।
ঈদ শেষ হয়েছে তিনদিন হল ।
গা থেকে পাঞ্জাবিটা খােলে
না রনক । গ্রামের মধ্যে হলুদ রঙের পাঞ্জাবিটা পড়ে ঘুরতে থাকে। তিন
রাস্তার মােড়ে এলে দুএকজন শিক্ষিত লােক ওকে জিজ্ঞাসা করে- কিরে হিমুর
পাঞ্জাবি কোথায় পেলি । আয় বস ।
বলে ওর দিকে হাতটা বাড়িয়ে দেয়। কিন্তু
রনক হাত ধরে না ।-
জান না? হিমুরা কারও হাত ধরে না?
তবে হিমু যেমন রাত্রে
খালি পায়ে হাঁটত, রনকও তেমনি হিমুর মতই হাঁটে, তবে খালি পায় না, চটি পরে।
আর সব থেকে মজার ব্যাপার হল- রনক হাঁটে দিনের বেলা, ঠিক দুপুর বেলা। সূর্য
যখন মাথার উপর থাকে । হাঁটে, আর মনে মনে হিমুর কথা ভাবে । হাঁটতে হাঁটতে
পায়ের চটিটা আকাশের দিকে লাথি মেরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। চটিটা রাস্তা থেকে
তুলে আবার পায়ে দেয়, আবার পা দিয়ে ছুঁড়ে দেয় । এভাবে হাঁটতে থাকে ।
এমনি করতে করতে চটির একটা রাস্তার পাশে ড্রেনে পড়ে যায় । কি আর করার । আর
তুলতে পারে না। খালি পায়ে রােদের মধ্যে রাস্তায় হাঁটতে ওর কষ্টই হচ্ছিল ।
কিন্তু মনে মনে সে খুবই খুশী হল । চটি জোড়া ছাড়া এখন সে পুরাই হিমু।
বাসায় ফিরে মা যখন খালি পায়ে বাসায় ঢুকতে দেখে তখন চটির কথা জিজ্ঞাসা
করতেই রনক চুপ করে থাকে। মাকে বলল যে, তার সেন্ডেল হারিয়ে ফেলেছে। একথা
শােনার পর মা রেগে গিয়ে রনককে একটু বেশিই বকে দিলেন ।
দিনদিন রনক
মিতব্যয়ী হতে থাকে হিমুর মত । স্কুলে যাওয়ার সময় মা রিক্সাভাড়া বাবদ
কিছু টাকা দেয় রনককে। যাওয়ার সময় হেঁটেই যায় রনক। কিন্তু আসার সময়
রিক্সায় চড়ে আসে। তবে একাই এক রিক্সায় করে আসে না। শেয়ারে রিক্সাভাড়া
করে বাসায় ফিরে । একই পাড়ার শফিকের সাথে আসে। এতে রিক্সাভাড়ার অর্ধেকটা
বাঁচায় রনক । কিন্তু মা সে কথা জানতে পারে না ।
অন্য পাড়ায় থাকে রসিদ ।
ওদের সাথে একই ক্লাসে পড়ে। বেচারা অনেকদিন হল টাইফয়েডে ভুগছে। সময় পেলেই
রনক রশিদের সাথে দেখা করতে আসে। সারাদিন গল্প করে। রশিদের জন্য রনকের খুব
কষ্ট হয়। সবসময় ওরা ক্লাসে একসাথে বসত । মাঝে মাঝে রশিদ রনকের বাড়ি এসে
ওকে খেলার জন্য ডেকে নিয়ে যেত।
রশিদের মা রনকের সামনে এসে শুধু
কান্নাকাটি করে। রনক রশিদের মাকে শুধু সান্ত্বনা দেয় । রনককে নিজের
সন্তানের মতই স্নেহ করে রশিদের মা।
সেদিন স্কুলে রােজদিনের মত ক্লাস হচ্ছিল । খবর পাওয়া গেল রশিদ খুব অসুস্থ
হয়ে পড়েছে। কিছুক্ষণ পর শােনা গেল, রশিদ আর বেঁচে নেই । স্কুলের সবাই
রশিদের বাড়ির দিকে ছুটে গেল ।
শফিক: কিরে, চল যাবি না।
রনক: হু, তুই যা।
শফিকের কথা শুনে রনক চুপ করে থাকে কিছুক্ষণ । প্রিয় বন্ধুকে হারানাের ফলে
তার যে কি কষ্ট হচ্ছিল তা তার চোখ দেখেই বুঝা যাচ্ছিল । চোখ দিয়ে ছলছল করে
জল পড়ছিল। একে একে স্কুলের সব ছাত্রছাত্রী চলে গেল ।
কিন্তু রনক গেল না।
মাথাটা নিচু করে মন খারাপ করে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগল । রশিদকে শেষ দেখা
দেখতে যায় না সে, কারণ সে জানে, “সন্তান শােকে কাতর মায়ের সামনে
দাঁড়ানাের ক্ষমতা হিমুদের দেয়া হয় নি, যে বাড়িতে মায়ের কোন সন্ত নি
মারা যায় সে বাড়িতে হিমুরা কখনও যায় না।”
একটা চাপা কান্না কাঁদতে
কাঁদতে বাড়ি পৌঁছাল রনক।
পরদিন বিকেলে রনকের খালামনি ওদের বাসায় এলাে ।
অনেকদিন পর খালামনিকে দেখে অনেকখুশি হল রনক। সেই ছােটকালের মতই আদর করে
খালামনি রনককে। খালামনি: আজ কি দিয়ে খেয়েছ বাবা।
রনক: তেলাপােকার স্যুপ
খালামনি ।
খালামনি: ওয়াক্ ... তেলাপােকার স্যুপ কি কেউ খায় নাকি? ছি ।
রনক: খালামনি ওটা আমার খুব প্রিয় খাবার ।
রনকের কথা শুনে ওর মাও খালামনি
দুজনই বিরক্ত হল।।
খালামনি: খুব দুষ্ট হয়ে গেছিস তাই না?
রনক: হ্যা,
তােমাদের মত আমারও বয়স বেড়েছে। আমি আর আগের রনক না । পরিবর্তিত রনক। ওর
কথা শুনে মা, খালামনি দুজনেই হেসে উঠল ।
খালামনি: পাগল ছেলে একটা। বড় হয়ে
গেছ তাই না?
রনক: না, আমি অত্যন্ত ক্ষুদ্র প্রাণী । ভেরি স্মল শর্ট,
জীবানু টাইপ।
রনকের এ রকম পাকনা পাকনা কথা শুনে খালামনি অবাক হয়ে গেল।
রনকটা হঠাৎ করেই মনে হয় বড় হয়ে গেছে। রনকের মধ্যে দিনে দিনে হিমু আর
মিসির আলীর অদ্ভুত চরিত্রগুলাে ফুটে উঠছে। অন্যরা বুঝতে না পারলেও এই
কাজগুলাে করে সে মনে মনে খুবই মজা পাচ্ছিল। স্কুলে প্রত্যেক দিনই কারও না
কারও কলম, পেনসিল চুরি হচ্ছিল।
ব্যাপারটা
এতটাই সিরিয়াস হয়ে গেল সে দিন রনকের ব্যাগ থেকে ওর নিজের কলমটা পর্যন্ত
চুরি হয়ে গেল। ব্যাপারটা নিয়ে ওরা সবাই টিফিন পিরিয়ডে বসল ।
নিজেকে তখন
মিসির আলী ভেবে রনক বলল থাম আমাকে ব্যাপারটা একটু ভাবতে দে। কিছুক্ষণ ভাবার
পর বিজ্ঞের মত মাথা নাড়ালাে রনক। তারপর কানে কানে ওদের কি যেন শিখিয়ে
দিল। পরদিন টিফিন পিরিয়ডে সবাই যখন বাইরে নাস্তা করতে যায় তখন রনক আর ওর
বন্ধুরা চুপিসারে সবার কলম আর পেন্সিলে লাল রং লাগিয়ে দেয়।
টিফিন শেষে
সবাই ক্লাসে এলে ব্যাগ থেকে যখন কলম বের করতে যাবে তখন দেখে দুজনের কলম
নেই। আর ওরা একজনের শুধু একটা কলমেই রং দিয়েছিল সবার কাছে কলম সার্চ করার
সময় দেখা গেল একজনের কাছে, তিনটা লাল রং করা কলম। তখন খুব সহজেই ওরা বুঝতে
পারল যে চোর আসলে কে। আর যাদের কলম হারিয়েছিল, তারাও তাদের কলম দেখে
চিনতে পারল ।
এদিকে অনেকদিন পর চোর ধরা পড়াতে সবাই খুব খুশি একই সাথে সবাই
প্রচন্ড মারমুখী হয়ে আছে । দুই তিন জন রেগে এসে কলম চোরকে চড় থাপ্পড়
দিল । রনক ওদেরকে বাধা দিল। পরে রনকের অনুরােধে সবাই ওকে মাফ করে দিল।
বেশ
শীত পড়েছে। এতাে সকালেও রনক গোসল করে স্কুলে যায় । আর গোসলের পরে ঠান্ডা
কমই লাগে । তাই হালকা শীতের কাপড় পরে স্কুলে যায় রনক ।
ওর বন্ধুরা ওকে
দেখে বলে - দোস্ত তাের রক্ত খুব গরম তাই না?
রনক বলে হুঁ, আর মটু গােপাল,
যে শীতের মধ্যে সপ্তাহ খানেক পরপর গােছল করে সে প্রশ্ন করে বসল- বন্ধু তাের
ঠান্ডা লাগে না? তুই কি কোন মন্ত্রতন্ত্র জানিস নাকি? রনক: হা জানি,
গুরুমুখী সপ্তবিদ্যা । এটা পড়লে ঠান্ডা লাগে না । আমার আধ্যাত্মিক ক্ষমতা
আছে।
ওর কথা শুনে সবাই হাে হাে করে হেসে উঠল । কিন্তু মটু গােপাল অবাক হয়ে
তাকিয়ে থাকে। ব্রাহ্মনের ছেলে কিনা! তাই মন্ত্রে তন্ত্রে একটু বেশিই
বিশ্বাস করে। রনকের কাছে এসে ওকে জিজ্ঞাস করে। আমাকে একটু শিখিয়ে দে না
দোস্ত ।
রনক: হ্যা দেব! সন্ধ্যার পর আমার সাথে দেখা করিস । কেউ যেন না
জানে।
মটু গােপাল : ঠিক আছে। আমি কাউকে বলব না ।
সেই দিনই সন্ধ্যা বেলায়
মটু গােপাল রনকের সাথে দেখা করার জন্য ওদের বাড়িতে আসে। রনক ওকে চুপি চুপি
ঘরের ভেতরে নিয়ে গেল ।
মটু গােপাল: মঞ্জটা শিখিয়ে দিবি না?
রনক: হ্যাঁ,
কানে কানে বলতে হবে। রনক কানে কানে ওকে মন্ত্রটা শিখিয়ে দিল ।
ইকির
বিকির
ভাওতা ফিকির
করছি যিকির
ছঁ মন্তর ছুঁ
এই মঞ্জটা পড়ে একশত একবার ডানে বামে
ঘুরবি। তারপর গোসল করৰি । দেখবি শীত করবে না।
মটু গােপাল: তাই!
রনক: হ্যা।
রনকের কাছে থেকে মন্ত্রটা শিখে খুশি মনেই বাড়ি ফিরে গেল মটু গােপাল ।
যাওয়ার আগে রনক ওকে নিষেধ করে দিল যেন একথা কাউকে না বলে । পরদিন স্কুলে
রনক বন্ধুদের সাথে বসে গল্প করছিল।
এমন সময় পেছন থেকে মটু গােপাল ওকে
দুহাত দিয়ে চেপে ধরল ।
এই ছাড় ছাড়
ছাড়বাে না, কাজ হয়েছে দোস্ত।
পরনে
শুধু সাদা শার্ট, একটুও শীত করছে না এখন আমার আর শীত করবে না, হা
সবাই কাছে
এসে এর কারণ জিজ্ঞাসা করল । তখন মটু গােপাল বিজ্ঞের মত মাথা
নাড়ালাে- না,
বলা যাবে না।
পাশ থেকে রনক শুধু মুচকি মুচকি হাসল।
এদিকে হুমায়ূন আহমেদ
এর পরিচালিত শ্যামল ছায়া, আমার আছে জল, ছবি ও দেখেছে। দিন যতই বাড়ছে উনার
প্রতি ভক্তি শ্রদ্ধা আর ভালবাসা ও দিন দিন বাড়ছে। প্রতি বছর একুশে বই
মেলায় তাই অপেক্ষা করতে থাকে আপু কখন বই কিনে ওকে পাঠিয়ে দেবে। এদিকে এস
এস সি পরীক্ষাও এগিয়ে আসছে। তাই পড়াশুনা নিয়ে সে অনেকটা ব্যস্ত হয়ে
পড়েছে। আর এখন মা বাবা কেউ ই হাতে অন্য বই দেখলে যে আর রক্ষা নেই সেটা সে
ভালভাবেই জানে। বুড়াে দাদুর শরীরটাও ভাল নেই ।
এসএসসি পরীক্ষা শেষ।
হাতে
অফুরন্ত সময়। সারাদিন বই পড়েই দিন কাটে রনকের। বন্ধুরা মাঝে মাঝেই শহরে
যায় সিনেমা দেখতে বা ঘুরতে । কিন্তু আর দশটা বাজে ছেলের মত স্বভাব রনকের
নয়। তবে একথা সত্য যে, সে আজ পর্যন্ত এক দিনও শহরে যায়নি।
এসএসসি
পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ পেল । জিপিএ ৫.০০ নিয়েই পাশ করল । কিন্তু ধর্ম
শিক্ষায় ৪ পাওয়াতে গােল্ডেন আর পেল না। একটু মন খারাপ হল বৈকি। শহরের এক
কলেজে এরপর ভর্তি হল ।
বাবা নিজে যেয়ে ভর্তি করে দিলেন । রনকের যাওয়ার
দরকার পড়েনি। এদিকে ক্লাস শুরু হবে। বই পুস্তুক কিছুই কেনা হয় নি । তাই
একদিন সে বাবাকে বলে- বাবা চল আমি তােমার সাথে বই কিনতে শহরে যাব । বাবাও
অনেকদিন ধরেই চাইছিলেন যে, ছেলেকে একদিন শহর থেকে ঘুরে আনবেন ।
ঠিক আছে
বাবা, আমরা কাল সকালে যাব ।
পথে যেতে যেতে মনে হল, শহরে নাকি ল্যাম্পপােষ্ট
আছে, সােডিয়াম লাইট আছে, যা সে চিনিছে এতদিন হুমায়ূন আহমেদের বই পড়ে ।
আজ সে নিজের চোখেই দেখবে সব কিছু। একটা চাপা উত্তেজনায় সে ঘামতে থাকে ।
বাস থেকে রিক্সায় করে শহরের বইয়ের দোকানে যায়। বড় বড় দোকান আর বড় বড়
বুকশেলফ এ সাজানো বই দেখে সে আত্মহারা হয়ে যায় ।
এই সবগুলাে বই যদি আমার
হত! মনে মনে ভাবে সে ।
পকেট থেকে বুক লিস্টটা বের করে দেয় বাবাকে, বাবা
দোকানিকে বুক লিস্টটা দিয়ে বলেন- ভাই - এই বইগুলাে আপনার কাছে হবে?
হা ভাই
হবে বসেন
দুজনে দোকানের ভেতরে গিয়ে বসে । বাবা পেপারটা হাতে নিয়ে পড়তে
থাকলেন। ঠিক তখনই রনকের চোখ গেল একটা হেডলাইনের উপর । বেশ মােটা অক্ষরে
ছাপা “চির বিদায় নিলেন হুমায়ূন আহমেদ”কিছুটা হতভম্ব হল সে ।
তারপর সে
দোকানদারকে জিজ্ঞাসা করল- যিনি মারা গেছেন তিনি কি সাহিত্যিক হুমায়ূন
আহমেদ?
দোকানদার তখন বলল- হ্যাঁ ভাই ।
এই কথাটা শুনার পরই সে একটা দীর্ঘ
নিঃশ্বাস তুলল। তারপর দুচোখ বেয়ে অঝােরে পানি পড়তে লাগল । নিউজটা ভালভাবে
পড়ল সে। হা উনি সেই হুমায়ূন যার বই পড়ে রনক এতদিন বিশ্বজগৎ সম্পর্কে
জেনেছে । প্রেম, ভালবাসা আর বিচ্ছেদ যন্ত্রনায় কেঁদেছে তার গল্পের
উপন্যাসের নায়ক নায়িকাদের মতােই।
যার সাথে একবার দেখা করার জন্য সে এত
দিন প্রহর গুণছিল সেই লােকটাই কিনা শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর কাছে পরাজিত হয়ে
আজ নিজেই এক কল্প নায়ক হয়ে গেলেন। সে ভেবেছিল আজ নিজে হাতে অন্তত তার
প্রিয় লেখকের একটা বই কিনবে ।
কিন্তু
বই কিনতে এসে তার মৃত্যু সংবাদ যে তাকে কতটা ব্যথিত করেছে তা রনকের চোখের
জল দেখে দোকানের সবাই অন্তত কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছে । বই কিনে বাড়ি
যাবার পথে সে দিনের একটা পেপারও কিনে নিয়ে গেল সে- যেখানে রচিত হয়েছিল
তার প্রিয় ঔপন্যাসিকের মৃত্যুকাহিনী ।
বাড়ি আসার পথে বাবার সাথে একটা
কথাও বলেনি রনক। শুধু চুপ করে ছিল । বাবাও রনকের মনের অবস্থা বুঝতে
পেরেছিলেন ।
বাড়ি ফেরার পথে রনক দেখল রাস্তার দুই পাশে হিমু আর মিসির
আলীরা কালাে ব্যাচ পরে মিছিল বের করেছে। এ কিসের মিছিল?
এই মিছিল তাদের
রূপকারের শােকের প্রতিবাদে বের হয়েছে । হুমায়ূন আহমেদ তাে বেঁচে নেই তাতে
কি? তাঁর সৃষ্টি হিমু আর মিসির আলী তাে আছে ।
হিমুদের পথ চলা কখনও থেমে
থাকে না। আর মিসির আলীদের অনুসন্ধিৎসু চোখ হাজারাে মায়াজালের মাঝে সত্য
উদঘাটনে পিছপা হয় না । হলুদ পাঞ্জাবির হিমু হুমায়ূন আহমেদকে যেমন খুঁজে
ফিরবে এদেশের আনাচে কানাচে, ঠিক তেমনি মিসির আলীর মত লােকেরাও হুমায়ূন
আহমেদকে যুগে যুগে আবিষ্কার করে তাঁর নাম ইতিহাসের পাতায় লিখে রাখবে
স্বর্ণাক্ষরে ।
৩ জুন ২০১৪




কোন মন্তব্য নেই