শকুন (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
বুকের বাম পাশটা প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে গিয়েছে। ভেজা স্যাঁতসেঁতে
মাটির উপর থক- থকে রক্ত জমাট বেঁধে আছে। তারই ভেতর মুক্তির স্পন্দনহীন
নিরুত্তাপ দেহ অনাদরে পরে আছে। কালাে মেঘে ঢাকা আকাশটা নির্মমভাবে চেপে ধরে
আছে চারপাশের মুক্ত বাতাসকে।
শহীদের বুকের ভেতরে যমুনার চর ধূ ধূ করে।
মুক্তি নেই। পৃথিবীর কোথাও নেই। নির্দয়ভাবে তাকে অত্যাচার করে হত্যা করা
হয়েছে। এ জীবনে আর মুক্তিকে কোথাও পাবে না সে। বৈশাখী দুপুরের মতাে হৃদয়
খাঁ-খাঁ করে উঠে তার। নিজের অজান্তেই ডুকরে কেঁদে উঠে শহীদ।
ঠিক তখনই ঘুম
ভেঙে যায়। শহীদ উপলব্ধি করে এতক্ষণ সে স্বপ্ন দেখছিল । ভয়ঙ্কর স্বপ্ন
জড়ানাে চোখে নির্বোধের মতাে ফ্যাল ফ্যাল করে চায় নির্জন ঘরের - চাবি
দেওয়ালে ।
ততােক্ষণে পুবের জানালা দিয়ে সকালের উজ্জ্বল রােদ এসে সব আঁধার
দূর করে দিয়াছে । তবুও একটা অপার্থিব আলাে-আঁধারী সকালের বাতাস ভারি করে
শঙ্কিত করে শহীদকে । দুহাতে জবা ফুলের মতাে লাল চোখ মুছে আবার সামনে চায়
শহীদ।
বাইরের ঘন কুয়াশা আর নেই। তবে দুঃস্বপ্নের বিহ্বলতা অবশ করে রাখে।
শহীদকে। অমঙ্গল আশংকায় বুক দুরু দুরু করে।
গ্রামের আজিম সরদারের মেয়ে
মুক্তি। শহীদের সহপাঠী এবং প্রায় সারাদিনের সঙ্গী। আজিম সরদার স্বাধীনতা
সংগ্রামে অংশগ্রহণ করে প্রায় সবাইকে হারিয়েছেন। তার
বর্তমান সম্পদের মধ্যে শুধুমাত্র ঐ কন্যা মুক্তি। সেই মুক্তিকে আজ দু’দিন
খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। মনকে প্রবােধ দেয় শহীদ।
প্রিয়জনের শঙ্কিত
অনুপস্থিতিই এ দুঃস্বপ্নের কারণ। এমনি সান্ত্বনা নিজের ভেতর অনুভব করে
শহীদ।
বাঁ হাতে পাশের জানালাটি খুলতে খুলতে খাটের উপর উঠে বসে শহীদ। ঠিক
তখনই বিরক্তিকর শব্দে একাধিক শকুন ডেকে উঠে। পর পর তিনবার। খােলা জানালায়
অল্প দূরের এক প্রকাণ্ড শিমুল গাছের মগডালে অনেক শকুনকে সাঁড়াশির মতাে
ঠোঁটে বাগিয়ে বসে থাকতে দেখে শহীদ। অবাক হয় এতাে সকালে শকুনের আগমন দেখে।
অশুভ একখণ্ড মেঘ তার উত্তাল মনের সব আলাে শুষে নেয় নিমিষেই।
শহীদের
ভালােভাবে মনে আছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় ঐ শিমুল গাছ আরও ছােট ছিল।
তার পাতার ছায়া এবং রাঙা ফুলের সৌরভ গায়ে মেখে দুটি নিস্পাপ পরিবার হাসি
আনন্দের সংগে মিলেমিশে ছিল অন্যান্য পরিবারের সংগে। আজ শূন্য ভিটা
দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। দুপুরে ঘুঘু ডাকে। শুকনাে পাতায় মচ মচ শব্দ তুলে চালাক
শিয়াল পালিয়ে যায়। ধূর্ত আজম ব্যাপারি এবং তার পেয়ারের পাকসেনারা দুটি
বাড়ির সবাইকেই গুলি করে হত্যা করে। আজম ব্যাপারি তখন রাজাকারের কমান্ডার।
এখন অবশ্য তিনি এলাকার সংসদ সদস্য। জনদরদী নেতা।
শহীদের মুখ ঘৃণায় কুচকে
যায়। থুথু আসে মুখ ভরে। আজম ব্যাপারির রাজাকার উপাধিটা এখন আর নেই।
পাকিস্তানের শত্রুদের মাথায় এখন ছাতা নেই। তাই চৈত্রের কড়া রােদ
পাকিস্তানের শত্রুদের সংগে সংগে আজম ব্যাপারির রাজাকার উপাধিটাও পুড়িয়ে
ছাই করে দিয়েছে। এ কারণে আবারও তার মন ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। বাঙালির চরিত্র
শকুনকে কবুতরে পরিণত করে। একটা বিড়ির মূল্যে ভােটের মর্যাদা ধর্ষিত হয়।
ব্যালট পেপার ছিনতাই হয়। রিলিফের গমের কৃতজ্ঞতা কিংবা ধর্মের ভণ্ডামি তাে
আছেই।
জানালায় আবার দৃষ্টি মেলে ধরে শহীদ। কাছেই আখ ক্ষেতে এখন শকুনগুলাে
লাফালাফি করছে। কখনও কখনও নেড়ী কুত্তাগুলােকে ধারালাে ঠোট উচিয়ে আক্রমণ
করছে। বিচিত্র হট্টগােলে সেখানকার পরিবেশ এখন জমজমাট। হয়তাে মরা গরুর
প্রবল আকর্ষণে নেশাগ্রস্ত হয়ে গেছে তারা।
আজ আজম ব্যাপারির জনসভা স্থানীয়
স্কুল মাঠে। তাকে আনুষ্ঠানিকভাবে মালা দিয়ে বরণ করা হবে কর্মীদের দ্বারা।
ছয় মাস পর গতকাল তিনি জেল হাজত থেকে ছাড়া পেয়েছেন। প্রতিদ্বন্দ্বী
মুক্তিযােদ্ধা রহিম শেখ হত্যা মামলায় তিনি প্রধান আসামী হয়ে হাজতে যান।
সাক্ষীর অভাবে এবং পুলিশের তদন্ত রিপাের্টের কারণে মামলার অভিযােগ
গঠন সম্ভব হয়নি। অবশ্য তদন্তকালে পর পর দু’জন পুলিশ কর্মকর্তা
রহস্যজনকভাবে অন্যত্র বদলিও হয়েছে। শহীদ মনে মনে সরকার ও পুলিশের প্রতি
কাল্পনিক থুথু ছিটায়। প্রকাশ্য দিনের বেলা হত্যা করা হলাে আর পুলিশ অপরাধ
খুঁজে পেলাে না। কঠোর সরকারি নিরাপত্তায় জনদরদী নেতাকে বাড়ি পৌছে দেওয়া
হলাে দেশ সেবার জন্য। গায়ে চাদর জড়ানাে অচেনা অনেক কর্মী দিয়ে স্কুল মাঠ
পাহারা দেওয়া হয়েছে কাল সারাদিন। গরমের দিনে চাদর গায়ে দেওয়া
স্বেচ্ছাসেবীদের কড়া পাহারায় জনসভা অনুষ্ঠিত হবে। মাঝে মাঝে পুলিশের
লােকজনও তাদের সালাম দিচ্ছে। চাদরধারীদের ক্ষমতার উৎস নিয়ে চারিদিকে
গােপনে আলাপ-আলােচনা হচ্ছে।
এলাকার ছাত্র-যুবক আর মুক্তিযােদ্ধারা আজম
ব্যাপারির জনসভা মঞ্চ নির্মাণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করেছে। ধর্মঘট পালন করেছে
জনসাধারণ। সম্ভবত এমন দেশসেবক না থাকলে দেশের মাথা মুরব্বিদের বউ তালাক
হয়ে যাবে এমন বিশ্বাসে পুলিশ আন্দোলনকারীদের প্রতি গুলি ছুঁড়ছে,
লাটিচার্জ করেছে, বন্দি করেছে অনেককে।
শহীদ কৌশলগত কারণে নিজ বাড়ি ছেড়ে
অন্যত্র আশ্রয় নিয়েছে। কাল রাতে বালিশে মাথা রাখা হয়নি তার। একদিকে
গা-ঢাকা দিয়ে এখানে আশ্রয় নিয়েছে, অন্যদিকে মুক্তির জন্য দুঃশ্চিন্তায়
এমন হয়েছে।
উচ্ছল শকুনগুলাের দিকে তাকিয়ে গত রাতের সব কথা মনে পড়ে তার।
হাসপাতালে পুলিশের গুলিতে এবং আঘাতে আহত বন্ধুবান্ধবের অবস্থা এখন কেমন
জানতে ইচ্ছে হয় তার।
বাহিরে মাইকে ঘােষণা শুনতে পায় শহীদ। কান পেতে শুনতে
চেষ্টা করে। বিকেল ৩টায় জনসভা। জাতীয় নেতারাও থাকবেন। আরও দূরে বাস
ট্রাকের আনাগােনা দেখে শহীদ অনুমান করে শ্রোতা সংগ্রহ অভিযানের যানবাহন
ওগুলাে।
গতকাল থেকেই অস্ত্রধারীদের পুলিশ সযত্নে রক্ষা করে জাতীয় কর্তব্য
পালন করেছে। গভীর দুঃখে হাসি পায় শহীদের। ভাবে দেশে গণতন্ত্রের ভিত
অস্ত্রের কল্যাণে ভীষণ মজবুত আজকাল। গৃহপালিত গণতন্ত্রের জন্য গর্বে সে
প্রায় ইদুর ভাবতে থাকে নিজেকে । উন্নয়নের জোয়ারে দেশটা ছাগলের মতাে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ
করলেও সে ইদুরই বয়ে গেল আজও। মনের দুঃখে হিঃ হিঃ করে হাসে শহীদ। তার পর
হাতে তােয়ালা নিয়ে খাট থেকে নেমে দাঁড়ায়।
পাশাপাশি কোনাে স্থানে পুলিশ
আছে কিনা গােপনে লক্ষ্য করে সে। উঠানে নামতেই বাড়ির দরজার ওপাশে একটা ছােট
জটলা চোখে পরে শহীদের । শুকনাে মুখে দাঁড়িয়ে আছে লােকগুলাে । অমঙ্গল
আশঙ্কায় খুব অসহায় বােধ করে সে। লােকগুলাের
আলাপ-আলােচনার প্রতি মনােযােগী হয় শহীদ। বাতাসে কান পাতে নীরবে...
মুক্তিযােদ্ধা আজিম সরদার আর তার মেয়ে মুক্তির মাটি চাপা দেওয়া লাশ আখ
ক্ষেতের ভেতর হতে শিয়াল কুকুর টেনে তুলেছে। মুক্তির পরনের কাপড় ছেড়া।
পাশবিক নির্যাতনের চিহ্ন দেহে।
চোখে অন্ধকার দেখে শহীদ। মুক্তির হাজারাে
স্মৃতি তাকে অস্থির করে। আর একবার আখ ক্ষেতের শকুনগুলাের দিকে চায়। সে
খবরটি শুনে অবাক হয়নি। শকুনগুলাে এখন দাপাদাপি করছে। একাত্তরের দিনগুলাের
স্মৃতি বিভীষিকার মতাে আগুন জ্বালায় তার দেহে, দৃষ্টিতে । মনে হয়, আগের
চেয়ে শকুনগুলাের ঠোট আরও তীক্ষ্ন হয়েছে।




কোন মন্তব্য নেই