চাবি (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
সারারাত কালাে মেঘে ছেয়ে ছিল বিশাল আকাশটা। অবিরাম অশ্রু ঝরেছে সে
আকাশ থেকে প্রায় সারাক্ষণ। সকাল থেকে সে অশ্রুঝরা থেমে গিয়েছে সত্যি
কিন্তু এখনও আকাশের দুঃখ কাটেনি। থমথমে মুখে আবার কান্নার পূর্বাভাস দিয়ে
যাচ্ছে।
আশ্বিন মাসের দুপুর রাতে আষাঢ়ের রিমঝিম বৃষ্টি। বেশ আছে পৃথিবী।
কোনাে দুঃখ নেই, সুখ নেই, কোনাে নিয়মের তােয়াক্কা করার প্রয়ােজনও নেই।
যা। ইচ্ছে তাই।
পর্দা সরিয়ে বাহিরে দৃষ্টি ছুড়ে দেয় শান্তনু। বাংলাদেশ
সিভিল সার্ভিস প্রশাসন একাডেমী ভবনের চারতলায় এখন সুনসান নীরবতা। রাজপথে
অসংখ্য রং-বেরং এর গাড়ি। মিউজিয়ামের পিছনে নিশ্ৰুপ ছায়া পড়া পুকুরের
কালাে জল। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় সবুজ বৃক্ষের সারি। মনে হয় কোনাে
স্বপ্নের সবুজ পৃথিবী। শুধু অনুভবের মতাে। চারিদিকে রােদ রােদ সুগন্ধ
ছড়িয়ে আছে বাতাসের শরীরে সে সুগন্ধ লুটোপুটি খাচ্ছে ফুটপাথে, পাতার
গায়ে, মেঘের নরম শরীর জুড়ে।
দিন আসে সুরের মতাে উচ্ছ্বাস নিয়ে, ছন্দের
মতাে উত্তাল হয়ে। কিন্তু চলে যায় নিঃশব্দে। কষ্টগুলাে নীরবে কাঁদে
সারারাত, সারাদিন, হাজার বছর ধরে...। শান্তনু অতীতের স্মৃতির মধ্যে তলিয়ে
যায়—
ঐ লাল সুগন্ধী পথের উপর দিয়েই কবিতার মতাে মসৃণ পা ফেলে শান্তনুর
পাশেই হেঁটেছিল একদিন সুধা। বিকেলের বাতাস আঁচল উড়িয়েছিল দুষ্টু ছেলের
মতাে। বন্ধনহীন চুলের অবিরাম আঘাত আজও অম্লান হয়ে আছে শান্তনুর দেহে,
স্মৃতিতে। এই তাে মধুর সেদিন, অথচ সেদিন আজ নেই। সুধা নামের জীবনের সেই অনিবার্য
সত্য আজ কেমন আছে জানে না শান্তনু। বুকের ভেতরটা এমন করে কেন? এমন কষ্ট
কেন?
বাইরে বেলকুনিতে এসে দাঁড়ায় শান্তনু। অসীম শূন্যতায় বাতাস হু হু
করে । কষ্টের পাখিরা নিঃশব্দে প্রহর গােনে।
বাহিরে রােদ ম্লান হয়ে এসেছে।
সন্ধ্যায় পাখিরা ফিরে যাচ্ছে আপন আপন নিবাসে। শান্তনু চেয়ে থাকে। একি
হলাে তার। অতীত তাে স্মৃতি হয়েই ছিল । কে এলাে আজ নতুন করে। কোথাও আগুন
নেই তবু দহনের এ জ্বালা কেন? এ কাকে দেখলাে আজ সে?
শান্তনু রংপুরের
ম্যাজিস্টেট। বাড়িতে শুধু মা আর এক বােন। বাবা নেই । আইন প্রশিক্ষণে
প্রশাসন একাডেমিতে এসেছে সে আজই ভােরে। নাইট কোচের যাত্রা সুখময় ছিল না।
সারারাতের একরাশ ক্লান্তির ছাপ দেহে নিয়ে একাডেমি অফিসের সামনে এসে
দাঁড়ায়, কক্ষ বরাদ্দের জন্য। পর্দা সরিয়ে ভেতরে দৃষ্টি মেলে ধরে
শান্তনু। পেছনে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে অন্য দু’জন। সম্ভবত তারাও
ম্যাজিস্ট্রেট। কথা বলছে অফিস সহকারীর সংগে ।
মৃদু সুগন্ধে বাতাস ভরে যায়
হঠাৎ, রজনীগন্ধা কি? মেয়েটি তন্বী দেহে রজনী গন্ধার সুবাস নিয়ে এসে
দাঁড়ায়। আনমনে ফিরে চায় শান্তনু । কিন্তু একি? এ-কে? এক হাজার জেট বিমান
ছুটে যায় আকাশ দিয়ে...। প্রচণ্ড সাইক্লোনে ধ্বংস হয়ে যায় সমস্ত পৃথিবী
। প্রশান্ত মহাসাগরের তীর ভাঙা ঢেউ তছনছ করে দেয় পৃথিবীর সব জনপদ। পায়ের
নিচের নরম মাটি কোথায় চলে যায় মুহূর্তে। দরজার হাতল ধরে নিজেকে সামলায়
শান্তনু । দু’হাতে মাথা চেপে ধরে আবার সামনে তাকায়। সবুজ চেক শাড়ি পরা।
মুখে হালকা মেকআপ । বৈশাখী মেঘ রং চুল। কানে মুক্তোর সাদা ফুল। সহকারীর
নিকট হতে কক্ষের চাবি হাতে নিয়ে সিঁড়ি ভেঙ্গে উপরে উঠে যায়। সে, পৃথিবীর
শ্রেষ্ঠ দুটি পা ফেলে। না, অবিকল সুধার মতাে হলেও সুধা নয় মেয়েটি । অন্য
কেউ ।
রক্তাক্ত হৃদয় নিয়ে ঘরে ফিরে আসে শান্তনু। একাডেমির চারতলার তার
নিজস্ব কক্ষটি আশ্রয় দেয় তাকে পরম সমাদরে । বিছানায় শুয়ে জানালায়
দূরের আকাশ দেখে শান্তনু। আকাশ জুড়ে সাদা মেঘেরা অজানা ইচ্ছায় ভেসে
যাচ্ছে কোথায় জানা নেই। কোলাহল নেই কোথাও। শূন্য বিছানায় হৃদয়ের ভেতর
করুণ সুরে বাঁশি বাজে। আবার জানালায় এসে দাঁড়ায় শান্তনু। মনে হয়
প্রকৃতির কোথাও কেউ নেই। চারিদিক নিবিড় নিঃশব্দ। দূরে মিউজিয়ামের ছাদে
দুটি পাখি গােপন অভিসারে মুখর। অনেক উঁচুতে ডানা মেলে উড়ছে দুইটি নিঃসঙ্গ
চিল ।
ডরমিটরি বয়ের পায়ের শব্দে চমকে উঠে শান্তনু। দরজার বাহির থেকেই
বাঁকে সে,
স্যার খাবার রেডিডাইনিং হলে সবাই আছেন। এখনই চইলা আসেন।
চনমন করে উঠে মন
। ড্রাইনিং হলে কি তাকে দেখতে পাবে? না অনেকক্ষণ বসেও তাকে দেখতে পায় না
সান্তনু। একলা বসে খেতে খেতে মনে হয়, কিসের জন্য বাঁচা। জীবন কেন? পাশে
থাকার কথা যার সে তাে আজ অনেক দূরে। শান্তনুর অহংকারের ফসল আজ ভণ্ড
দেশপ্রেমিকের বিলাস সামগ্রী। জীর্ণ স্মৃতি বন্ধ রেখে সে তাে সুখেই আছে।
কষ্টের পায়রার হৃদয় স্পন্দন সেখানে সময়ের জঞ্জাল মত্রি । অতীতের কোনাে
বিষন্ন দুপুরই হয়তাে আজ আর সুধার মনে দুঃখী চিলের ডানা হয়ে আকাশে-আকাশে
ওড়ে না। হায়রে নিয়তি। চমকে উঠে শান্তনু...
চুড়ির রিমঝিম ঝংকার, সংগে
রজনীগন্ধার সুবাস বাতাসে ছড়িয়ে পাশে এসে বসে সেই মেয়েটি। নিজেকে সংযত
রেখে মুখ তুলে চায় শান্তনু। ঘিয়ে রং-এর শাড়িতে যত্ন করে নিজেকে সাজানাে।
শান্তনু স্বাভাবিক হতে চেষ্টা করে। স্বচ্ছ দাঁতে আলাের ঝিলিক মেখে হাসে
মেয়েটি। হাসি নয় যেন যন্ত্রণা। উত্তপ্ত বালির মরুভূমি হৃদয় জুড়ে থাকার
যন্ত্রণা।
আমি কিশােরগঞ্জের ম্যাজিস্ট্রেট, রুনা।
প্রথমেই কথা বলে মেয়েটি।
ডাইনিং হলের বাতাসে কবিতারা লুকোচুরি খেলে। ফুলেরা সব ভুলে শুধুই গন্ধ
ছড়ায়। গানেরা সুরে সুরে ঝংকার তুলে। পৃথিবী রঙিন হয়ে যায় মুহূর্তে।
শান্তনু নিজের পরিচয় দেয়,
আমি শান্তনু। রংপুরের ম্যাজিস্ট্রেট...
হৃদয়ে
ঝড় উঠে। আর কিছুই বলা হয় না। কথা বন্ধ হয়ে যায়। খাবারের সময় উত্তীর্ণ
হয়। টলতে টলতে ঘরে ফেরে শান্তনু। মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে, কাল যে ভাবেই
হােক তাকে বলবে, যে রুনা হুবহু তার হারিয়ে যাওয়া সুধার মতাে।
গভীর রাতে
আবার ঝর-ঝর করে বৃষ্টি আসে। কোনাে এক চোখের উদাস দৃষ্টি, চুলের অরণ্য,
কণ্ঠের মূৰ্ছনা মুছে দেয় ঘুমের সকল সম্ভাবনা। চিন্তারা আবার নিঃশব্দে
গ্রাস করে শান্তনুকে। অনেক বছর আগের সেই ভয়ঙ্কর রাত তাকে ক্ষত বিক্ষত করে ।
নিঃশব্দ ঘুঘু ডাকা দুপুর এবং হাজারাে মুহূর্তের সঙ্গিনী অনিবার্য এক
ফাঁসির মঞ্চে নিজের দেহ বিসর্জন দিল । রাজাকার দেশপ্রেমিকের দামী গাড়িতে
চড়ে এবং বেনারসীতে নিজেকে জড়িয়ে গর্বিত উঠোনের বাসিন্দা হয়ে গেল সুধা।
হাজারাে মুক্তিযােদ্ধার রক্তের অহংকার দালালের গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে
গেল চিরদিনের মতাে। প্রতিবাদ করতে পারেনি শান্তনু।
সারাদিন অবসর। আজ কোনাে
ক্লাস নেই । নাস্তার টেবিলে রুনার সংগে দেখা হয়েছে। রুনা আজ ডরমিটরিতে নেই
। সকালে তার বাবা এসে তাকে বাসায় নিয়ে গিয়েছেন। কি একটা জরুরি অনুষ্ঠান
আছে । কিসের অনুষ্ঠান? বিয়ে? রুনার বিয়ে?
সারাদিন
বাসায় শুয়ে শুয়ে মনে মনে অসংখ্য কবিতা লিখে শান্তনু
পাখির ডানায়
নিবিড় সুখের মায়া
সবুজ মাঠে মুগ্ধ আলো ছায়া...
সিদ্ধান্ত নেয় শান্তনু।
আর নয়, রুনাকে তার চাই ।
ঝুমঝুম, হাতে চাবিরগােছা আর রং-এর সরঞ্জাম
নিয়ে চাবিওয়ালা আসে । বুদ্ধিদীপ্ত চোখ। মুখে ছন্দময় স্লোগান,
বাক্স রং,
তালা মেরামত, চাবি চাই... চাবি...
ছেলেটি দরজায় এসে দাঁড়ায়। মিহি কণ্ঠে
বলে,
সাহেব চাবি লাগবাে? পুরাতন নসে রং কইরা নতুন কইয়া দিবার পারি ।
চিনতেই পারবাে না কেউ। আপনারা যেমন রাজাকাররে রাজা বানাইতে পারেন; তার
থাইকাও বেশি ঝকঝকা কইরা দিমু। বুঝবারই পারবেন না ।
চাবিওয়ালার যুক্তি
অকাট্য। তাইতাে সুধাকে পাবার কোনাে চাবিইতাে তার কাছে নেই। এমনকি রুনাকে
পাবার চাবিও তার নেই...
চাবিওয়ালা আবার বলে, স্যার চাবি লাগবে?
শান্তনুর
কোনাে উত্তর নেই, চাবিওয়ালা রহস্যের হাসি হাসে। তারপর ঝুমঝুম শব্দ করতে
করতে সামনে এগিয়ে যায় ।
রুনার কাজল চোখ এখনও নীরবে শান্তনুর মন ছুঁয়ে
আছ। অথচ রুনা জানে না নিথর এক দীঘির শান্ত জলে কিসের আলােড়ন তুলছে সে ।
বিছানায় উঠে বসে শান্তনু। হঠাৎ করেই সিদ্ধান্ত নেয় রুনাকে তার চাই । আর
কোনাে রাজাকারের নিকট পরাজিত হওয়া যায় না। কাছে ডাকে চাবিওয়ালাকে—
চাবি
লাগবে স্যার? শান্তনুর ডাক শুনে চাবিওয়ালা জিজ্ঞাসা করে,
কিসের চাবি আছে
তাের কাছে ?
বাক্সের, আলমারির, ঘরের...
হয়েছে থাক, ধমক দেয় শান্তনু। আর
কোনাে চাবি নেই তাের কাছে ? রুনার মনের চাবি? সবচেয়ে নিজস্ব অন্য এক মনের
চাবি? যেখানে সূর্যের আলাে পড়েনি, বাতাসের ছােয়া লাগেনি...
অবাক চোখে
চায় ছেলেটি। মুচকি হাসে। তারপর পৃথিবীর সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ বিক্তের মতাে বলে,
রাজাকারে লইয়া গ্যাছে স্যার । বুঝবার পারতাছি, আপনারও কিছু একটা কাইরা
লইছে। আর পাইবেন না স্যার, আর পাইবেন না। রাজাকারদের ঘাড়ে উঠাইয়া লইছেন।
চাবিটা আর ফেরত পাইবেন না ।




কোন মন্তব্য নেই