Header Ads

বড় মাছ (আহসানুল হক আসিক) ছোট গল্প।


golpo kotha

আহসানুল হক আসিক


বড় মাছ

ডুবি ডুবি করে বড়শির সিপটা ডুবে গিয়ে পরে যখন আবার ভেসে উঠল, তখন রহমত মিয়ার মেজাজটা অনেক গরম হয়ে গেল। একে তাে বড়শিতে মাছ ধরছে ,তার উপর মাথার উপরে সূর্যের প্রখর রােদ। সব মিলিয়ে রহমত মিয়ার চেহারা একদম দেখার মত, একেবারে অগ্নিমূর্তি।

মাছেরাও আজকাল চালাক হয়ে গেছে। বড়শির টোপটা যেন গিলতেই চায় না। দুপুর গড়তেই থলেতে যে কয়েকটা মাছ পেয়েছে সেগুলাে নিয়ে বাড়ির পথে রওনা হল সে।

কিরে রহমত, শুনলাম তাের নাকি বেটা সাওয়াল হইছে? পেছন থেকে জমির হােসেন ডাক দিল। পেছন ঘুরে মুখে কিঞ্চিৎ হাসি নিয়ে রহমত মিয়া জবাব দিল -হ ভাই আল্লাই দিছে ।

জমির মিয়া আরও কথা বাড়ানাের আগেই সে হাঁটা শুরু করল । জমির মিয়া লােকটা খুব একটা সুবিধার নয়। তার অনেক জমি। তবে অর্থলােভী । তার চরিত্রটা কিছুটা তরল পদার্থের মত যে পাত্রে রাখা হয়, সেই পাত্রের আকারই ধারণ করে। অর্থাৎ গ্রামের বিচার শালিসে এক পক্ষের টাকা খেয়ে অন্য পক্ষের বিরুদ্ধে কথা বলে। এজন্য গ্রামের কোন লােকই তাকে ভাল চোখে দেখেনা । গ্রামের অনেক গরীব লােককে সে ঠকিয়েছে । তবে ওর অনেক টাকা বলে ওর বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না।

পরপর তিনটি মেয়ের পর যখন রহমত মিয়ার একটি ছেলে হল, তখন নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে লাগল। এই একটি ছেলের জন্য সে তার বউ এর সাথে কত খারাপ ব্যবহারই না করেছে রাতদিন। প্রতিদিন মারধাের করত। এমনকি কোন কোন দিন খেতে পর্যন্ত দিত না। ছােট ছােট তিনটি মেয়ে তাদের এই পাষন্ড বাবাকে কিছু বলতেও পারত না।

শুধু মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করত । তবে বাঙালি ঘরের বউ বলে কথা, স্বামীর শত অত্যাচার সহ্য করেও স্বামীর ঘর ছেড়ে যায় নি কোনদিনও ।

দেখি দেখি বাপধন আমার বলতে বলতে বারান্দায় বিছানা থেকে ছেলেকে কোলে তুলে নিল রহমত মিয়া । ছেলের মুখে, কপালে, গালে চুমু খেতে লাগল।

বউ বউ বলে ডাক দিতেই ঘর থেকে বের হয়ে এলাে খালিসা। মুখে তার এক টুকরা হাসি । নিজের বউয়ের মুখে অনেকদিন পর হাসি দেখে মনটা খুশিতে ভরে উঠল রহমত মিয়ার । মনে মনে সে লজ্জিত। কতই না অত্যাচার করেছে সে তার বউয়ের উপর। অনুতপ্ত মনে নরম গলায় বউকে বলল- বউ পােলাডার নাম কি রাখবি ঠিক করেছিস?

না আপনি যেইডা রাখবেন, সেইডাই হইবাে।

না, আমি না, তাের নামের সাথে মিল রাইখা একটা নাম রাখবি । এহন , খাওন দে হু, দিতাছি ।

রােজ দিনকার মত মাছের তরকারি দিয়ে খেতে বসে রহমত। তবে আজকের স্বাদটা কেমন জানি একটু অন্যরকম। একটু বেশিই ভাল । কে জানে, হয়তাে রহমতের মনটা আজ ভাল, তাই রান্নাটাও ভাল লাগছে তার। খেতে খেতে বাড়ির চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিল রহমত ।

হু মাইয়ারা কই? ওগাে দেহি না যে!

ওরা তাে মন্ডলের বাড়ি গেছে ।

কেন?

আপনি কিছুই জানেন না?

কি হইছে?

খালিসা পুরাে ঘটনাটা তখন খুলে বলল ।

কয়েকদিন আগে মন্ডলের মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়। কাল ওর বিয়ে হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আজ সকালে বেচারির মেয়েটা এক বােতল বিষ পুরােটা খেয়ে ফেলে। ঘরে ঢুকে সবাই যখন দেখে যে মেঝেতে পরে আছে, তখনই সবাই ওকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যায়। তবে কপাল ভাল মেয়েটার। এক বােতল বিষ পুরােটা খাওয়ার পরেও বেঁচে গেছে। কারণটা জানার পর সবাইতাে অবাক হয়ে যায়। ডাক্তারকে জিজ্ঞাসা করলে উনি বলেন, বিষে ভেজাল ছিল । পরে অবশ্য মেয়েটার বিষ খাওয়ার কারণ জানা গেছে। পাশের গ্রামের একটা ছেলেকে ভালবাসত। অন্য কারও সাথে বিয়ে হচ্ছে, সেজন্য দুঃখে বিষ খেয়েছে । মেয়েটা এখন সুস্থ আছে । বাড়িতে আনার পর গ্রামের সব লােক মেয়েটাকে দেখার জন্য গেছে, রহমতের মেয়েরাও গেছে দেখতে।

পরদিন সকাল বেলা মাছ ধরার জন্য বড়শি নিয়ে রহমত আবার বাড়ি থেকে রওনা হয় । পথে যেতে যেতে আবারও সেই জমির মিয়ার সাথে দেখা হয়। সকাল সকাল এরকম একটা খারাপ লােকের মুখ দেখে মাছ ধরতে গেলে একটা মাছিও পাবে না সে । এরকম চিন্তা মনে হতেই জমির মিয়াকে পাশ কাটিয়ে গেল রহমত ।

ঐ রহমত শােন, আজ যা মাছ পাৰি, সন্ধ্যার আগে আমাগাে বাড়িতে দিয়ে যাস । বাড়িতে মেহমান আইছে ।

রহমত মিয়া একবার ভাবল উত্তর দিবে না, পরে ভাবল, মাছ দিলে তাে টাকা পাওয়া যাবে, তাই বেশ জোরেই উত্তর দিল-

আচ্ছা ঠিক আছে ।

না, আজ কপালটা ভাল রহমতের। জমির মিয়ার সাথে দেখা হওয়ার পর যা ভেবেছিল তা নয়। বড়শির টোপগুলাে মাছেরা একটার পর একটা গিলছে । আসলে রহমতের না, জমির মিয়ার কপাল ভাল, মাছেরা আজ ওর পেটে যাওয়ার নিয়ত করেছে।

বিকাল পড়তেই থলেতে অনেকগুলাে মাছ দেখে বরশিগুলাে তুলতে থাকে। এমন সময় শেষ বড়শিতে টান পড়ে। তুলতে যেয়ে দেখে একটা শােল মাছ। বেশ বড়সড়ই। রহমতের আনন্দ দেখে কে? ভাবল, আজ অনেকদিন পর সবাই মিলে শােল মাছ খাবে মজা করে ।

বাড়ি যাবার পথে জমির হােসেনের বাড়িতে মাছ দিতে যায় রহমত। থলি থেকে মাছ তুলে দিচ্ছিল রহমত । জমির মিয়ার বউ থলির ভেতরে শােল মাছটা দেখতে পেয়ে জোর করে রহমতের থেকে মাছটা নিয়ে নেয়। রহমত না দেওয়ার কথা বললেও সে কথা শােনে না। রহমত বেশি কিছু বলার আগেই জমির মিয়া বলে দিল- কাল। বিকেলে এসে টাকাটা নিয়ে যাস । 

ভাই, টাকাডা আইজকে দিবেন না?

না

থলেতে খাওয়ার জন্য কয়েকটা মাছ রেখে টাকা না নিয়ে বাড়ির দিকে চলে গেল রহমত। বাড়ির ভেতরে ঢােকার আগেই বাইরে থেকে রহমত তার ছেলের কান্না শুনতে পেল। হাত থেকে থলিটা রেখেই খালিসার কোল থেকে ছেলেকে নিজের কোলে তুলে নিল

পােলাই কান্দে কে?

ওর খাওনের সময় হইছে, আমারে দেন।

বলে স্বামীর কোল থেকে বাচ্চাকে নিয়ে ঘরের ভেতরে চলে গেল । বড় মেয়েটা চুলােয় আগুন ঠেলছিল, মেঝাে আর ছােটটা আঙিনায় এক্কা দোক্কা খেলছিল । বড় মেয়েটা কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবাকে খেতে ডাকে। সবকিছু ভালই চলছিল। এমন সময় মেঝাে আর ছােট মেয়েটা খেলতে খেলতে ঝগড়া শুরু করে দিল। তারপর চুলােচুলি । রহমত খাওয়া থেকে উঠে মেয়েদেরকে থামিয়ে দেয় ।

এ রকম ঘটনা আজ নতুন নয়। প্রায় প্রতিদিনই এরকম ঝগড়া হয়।

তবে মেয়ে দুটো এই ভেবে অবাক হল যে, অন্যদিন ওরা ঝগড়া করলে ওদের বাবা রেগে গিয়ে ওদের গালাগালি করত। এমনকি মারধরও করত। কিন্তু আজ রহমত শান্ত গলায় ঝগড়া না করতে উপদেশ দিল। তারপর ওদেরকে হাত ধরে বারান্দায় নিয়ে ওর খাওয়ার পাশে বসিয়ে দিল ।

মেয়েরা তাদের পাষন্ড পিতার এরকম সুন্দর ব্যবহারে অবাক হয়ে গেল । শুধু একে অপরের দিকে বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে থাকল।

পরদিন একটু বেলা করেই ঘুম থেকে উঠল রহমত। শরীরটা তার আজকে কেমন কেমন জানি করছে । ভাবছে আজ মাছ ধরতে যাবে না। ছেলের সাথে কিছুটা সময় কাটিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল রহমত । বিকালে বাড়ি ফেরার পথে জমির এর বাড়িতে গতকালের মাছ বিক্রির টাকা নিতে গেল। জামির বাড়িতে ছিল না। ওর বউ বের হয়ে এসে রহমতের হাতে কয়েকটা নােট গুঁজে দেয়।

এই নে?

কত দিলেন ভাবি?

ত্রিশ টাকা

পঞ্চাশ টাকা হয় তাে

ঔ কয়েকটা মাছ পঞ্চাশ টাকা?

আর পাবি না যা 

জমির এর বউ রহমতের কথায় কান না দিয়ে ওর মুখের উপরে ঘরের দরজাটা খটাশ করে বন্ধ করে দিল । মনে মনে জমির আর তার বউকে গালি দিল রহমত। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারল না। সে সাহস যে তার নেই ।

তার মত হত দরিদ্র লােকদের জন্ম হয় অন্যায়কে মেনে নেয়ার জন্য, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্য নয় ।

রহমত মিয়ার বড় মেয়ের বয়স পনেরাে, নাম রুপালি । এরই মধ্যে ডজনখানেক পাত্র দেখা হয়ে গেছে। গরীব মানুষ, তাই সে চায় মেয়েকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে মাথার বােঝাটা হালকা করতে । অনেক জায়গা থেকে অনেক সম্বন্ধ এসেছিল। কিন্তু মেয়ের বাবা গরীব বলে, গরীব ঘরে কোন বাবাই তার ছেলেকে বিয়ে দিতে রাজি হয়নি । বাগানের ফুল যত সুন্দরই হােক না কেন বন্য ফুলের থেকে এর গন্ধ ও সৌন্দর্য কোন অংশেই যেমন বেশি নয় ঠিক তেমনি গরীব ঘরের মেয়ে হলেও রূপে গুণে অনন্যা এই মেয়েটি।

একটার পর একটা বিয়ে যখন ভেঙে যাচ্ছিল তখন মেয়েটা শুধু নিরবে চোখের জল ফেলে। রহমত মিয়াও কিছু বলে না। কারণ নিজের অবস্থা সে ভালভাবেই জানে । তবে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে দু হাত উপরে তুলে বলে- খােদা, কি এমন অপরাধ করেছি যে, এত বড় শাস্তি দিচ্ছ ।

সৃষ্টিকর্তা মাঝে মাঝে মানুষকে পরীক্ষায় ফেলে দেন। তারপর হয়ত তাকে এমনভাবে পুরস্কৃত করেন, যা সে কল্পনাতেও ভাবতে পারে না । রহমত মিয়ার মেয়ের কপালে ঠিক সে রকমই একটা ভাল পুরষ্কার লিখে রেখেছিলেন। গ্রামের প্রাইমারী স্কুলে একজন নতুন মাস্টার এসেছেন। সাইকেলে করে তিনি একদিন টিউশনি করাতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় রূপালিও বাড়ির বাইরে শাকপাতা তুলতে এসেছিল। প্রথম দেখাতেই রূপালিকে তার ভাল লেগে যায় ।

মাস্টারের বাড়ির লােক রূপালিকে কোন ভাবেই তাদের ছেলের বউ করে আনতে রাজি নয়। তবে একমাত্র ছেলের জিদ এর কাছে হার মানতে বাধ্য হয়। বউ হয়ে রূপালি আসে মাস্টারের বাড়িতে। কে জানে হয়তাে এই বড় পুরস্কারটি দেওয়ার জন্যই সৃষ্টিকর্তা প্রথমে কাঁদিয়ে পরীক্ষা করছিলেন!!!

দিন যায়, রহমত মিয়ার আদরের ছেলেটা বড় হতে থাকে। হামাগুড়ি দিয়ে হাঁটতে শিখেছে। কাদা আর পানি দেখলেই সেই দিকে ছুটে যায়। পানির প্রতি তার খুব টান। আর হবেই না বা কেন?

ওর বাপ দাদা সবাই তাে সারাজীবন এই পানিতেই মাছ ধরে জীবন কাটিয়ে দিয়েছে। পানির প্রতি টানটা তাই ওর বংশগত ।

পরিবারের অবস্থা ভাল নয়। গ্রীষ্মকাল । তাই খাল-বিল শুকিয়ে গেছে। মাছও খুব একটা পাওয়া যায় না আজকাল । তাই চাল, ডাল কিনতে পারে না প্রতিদিন কোন দিন অনাহারে, কোনদিন অর্ধাহারে দিন কাটায় পরিবারের সবাই । ছােট বাচ্চাটা মায়ের দুধও পায় না ঠিকমত । তাই কান্নাকাটি করে রাতদিন ।

তার উপর মেয়েকে বিয়ে দিয়ে হাতে টাকা পয়সা কিছুই নেই । গরীব বলে বিয়েতে মেয়েকে কিছুই দিতে পারে নি সে । তাই বলে কি তার শখ করে না, যে বাবা হয়ে মেয়েকে কিছু দিতে?

স্যাকরার কাছে আধা আনি সােনার কানের দুল বানাতে দিয়েছে সেই বিয়ের আগেই । কিন্তু টাকার অভাবে সেটা আর নিয়ে আসা হয় নি। এসব কথা মনে করে রহমত রাতদিন শুধু নিজের এই আটকপালে ভাগ্যটাকেই দায়ী করে । আঙিনার সামনে মাচা করে লাউ শাক এর গাছে পানি দিচ্ছিল রহমতের বউ। পাশে বসে থেকে ওর ছেলেটা খেলছিল । রহমত ওর ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বলল- বউ, গাছে তাে ভালই লাউ ধরছে। 1

হু

একখান কাজ কর । এইহান থাইক্যা একখান লাউ তুইলা আমারে দে। বড় মাইয়ার বাড়ি যামু। অনেকদিন মাইয়াডারে দেহি না।

মেয়ের কথা বলতেই রহমতের বউ কেঁদে উঠল । শাড়ির আঁচল দিয়ে মুখ ঢেকে কাঁদতে লাগল। রহমতের ছেলেটাও মায়ের কান্না শুনে কেঁদে উঠল । রহমত ওর বউয়ের কষ্টটা বুঝতে পারল । হাজার হােক মেয়েকে তাে সেই পেটে ধরেছে। রহমতের চেয়ে মেয়ে হারানাের বেদনাটা তার অনেক বেশি। ছেলেকে কোলে দিয়ে বলল-

কাঁদিস না, ঘরে চল ।

গত কয়েক দিন হল রহমত মিয়া একটা মাছও পায় না ।

সেদিন টাকার জন্য জমির মিয়ার বাড়ি যায় রহমতের বউ। হাতে পায়ে ধরে কিছু টাকা ধার দেয়ার জন্য। কিন্তু জমির মিয়া টাকা ধার দেয় না। উল্টো তাকে বকাবকি করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় । রহমতের বউ বেশ ভালভাবেই জানত সে টাকা দেবে না, তবুও সে এসেছে।

জমির মিয়া লােকটাকে কেমন জানি ভরসা করে । টাকা না পেয়ে কাঁদতে কাঁদতে রহমতের বউ জমির মিয়া বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল ।

খানিকটা পথ যাওয়ার পরই পেছন থেকে কে যেন ওর নাম ধরে ডাকল । পেছন ফিরে তাকিয়ে দেখল জমিরের বউ হাত নেড়ে ইশারা করে ওকে ডাকছে ।

ধীরে ধীরে খালিসা এগিয়ে এলাে। ওর হাতটা ধরে পেছনের দরজা দিয়ে খালিসাকে বাড়িতে নিয়ে এলাে জমিরের বউ । ঘরে গিয়ে কেজি দুয়েক চাল ঢেলে দেয় খালিসার শাড়ির আঁচলে । খালিসা এটা দেখে আবেগে কেঁদে উঠল । তখনই জমিরের বউ হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরল। পাশের ঘর থেকে জমির মিয়া শুনতে পেলে আস্ত রাখবে । চাল ঢেলে দিয়ে তাড়াতাড়ি করে খালিসাকে বাড়ি থেকে বের করে দিল জমির মিয়ার বউ ।

খালিসা আর জমির মিয়ার বউ এর বাবা একই গ্রামের মানুষ । খালিসা এসে মাঝে মাঝেই জমিরের বউয়ের কাজ করে দেয়। একই গ্রামের মেয়ে বলে একে অন্যের প্রতি কিছুটা দুর্বল ছিল ওরা। তাই স্বামী অপমান করে তাড়িয়ে দেওয়াতে খালিসার কষ্ট সে ঠিকই বুঝেছে। আর তাই এই বিপদের সময় খালিসার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে । খালিসা চলে গেলে জমিরের বউ একটা হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।

বলে- আল্লাহ ওদের দেখাে।

জমিরের বউয়ের দেয়া চাল দিয়ে দিন দুয়েক খেয়ে পরে ভালই কাটল রহমতের পরিবারের। তারপর আবারও অভাব । অভাবের সময় মাথা ঠিক থাকে না রহমতের। কথায় কথায় মেয়েদের সাথে খারাপ আচরণ করে। আর ছেলেটা কেঁদে উঠলে এমন ঝাড়ি দেয়, তাতে কান্নাটা থামে না, বরং আরও বেড়ে যায়। আর সব দোষ পড়ে খালিসার উপর। এভাবে অনেক দিন কেটে যায় খেয়ে না খেয়ে কোন রকমে ।

অনাহারে অর্ধাহারে কাটানাে দিনগুলাের সমাপ্তি ঘটে ধীরে ধীরে।

গ্রীষ্মের তাপদাহের পর আসে বর্ষা। আকাশে মেঘের গর্জন ক্রমাগত বাড়তেই থাকে। আর বিজলির ঝলক পৃথিবীতে এক নতুন রূপদান করে। মাঠ ঘাট পানিতে থই থই করতে থাকে। এখানে সেখানে পানি আর পানি। আর সেই পানিতে অসংখ্য মাছ এর দাপাদাপি।

কয়েকদিন আগেও সেখানে মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছিল সেই জমিতে এখন পানির নিচে মাছের চলাফেরা দেখা যায় । সৃষ্টিকর্তার লীলা বুঝা দায়।

হয়তাে আকাশ থেকেই মৎস্য বৃষ্টি হয় কে জানে! এই বর্ষা রহমত মিয়ার কাছে আর্শীবাদ । 

বর্ষা এলে রহমতের পরিবারে স্বচ্ছলতা ফিরে আসে। সারাদিন রাত মাছ ধরে। হাতে অনেক টাকা আসে। রহমত মাছ ধরে বাড়ি ফিরলে খালিসা কিছু মাছ থলি থেকে বের করে। আর সেগুলাে নিয়ে ছেলেটা খেলা করে । কখনও লেজে হাত দেয়, ভয় পেয়ে আবার হাত গুটিয়ে নেয়। এভাবে মাছ নিয়ে খেলা করে ।

মানুষের হাতে যখন টাকার আধিক্য দেখা দেয়। তখন তার মেজাজও ভাল থাকে। রহমতের মেজাজটাও আজকাল ভালই থাকে। রােজই মাছ বিক্রি করে সবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসে। মেয়ে দুটোর জন্য জামা আর বউ এর জন্য শাড়ি। আর সবচেয়ে আদরের ছেলের জন্য কয়েকটা করে খেলনা। এরই মধ্যে রহমত বড় মেয়ে ও তার জমাই এর জন্য অনেক কিছু কিনে দিয়েছে ।

রােজ সকালে রহমত বড়শি ও জাল নিয়ে যখন মাছ ধরতে যায় ছেলেটা ওর পিছু পিছু যায় । সদ্য হাঁটা শিখেছে । দুএকপা হাঁটতে যেয়ে পড়ে যায় । রহমত অনেক কষ্টে ওকে রেখে চলে যায়। চুপি চুপি বারান্দা থেকে নেমে আঙিনায় খেলা করে । গায়ে কাদা মাটি মেখে মিছামিছি মাছ ধরে। কেউ ধরতে এলে গায়ে কাদামাটি দিয়ে দৌড়ে পালায় ।

এত ছােট বয়সেই বেশ পাকনা হয়ে গেছে ছেলেটা। বােনেরা তাদের এই আদরের ভাইটাকে সব সময়ই চোখে চোখে রাখে। মাঝে মাঝেই খালিসাকে ব্যস্ত থাকতে হয় রান্না ঘরে । তাই বাচ্চাটাকে সবসময় দেখে রাখতে পারে না সে। সেদিন মাছ বিক্রি করে বিকালে বাড়ি আসে রহমত। বাড়ি এসে দেখে ছেলেটা কাদার মধ্যে গড়াগড়ি করে খেলতেছে। বাড়িতে কাউকে দেখা যাচ্ছে না। রান্নাঘর থেকে শুধু ধোঁয়া উড়ছে। ছেলেকে টেনে তুলে বারান্দায় এসে খালিসাকে ডাক দিল। খালিসা চোখ মুছতে মুছতে বের হয়ে এল।

রহমত: বাড়িতে কেউ নাই ক্যান? পােলাডা কাদার মধ্যে খেলে দেহস না? মাইয়াগুলা কই গেছে?

খালিসা: ওরা তাে ভক্ত পূজা দেখতে গেছে। নতুন কাপড় পরে ।

রহমত: পােলাডা একা একা খেলতেছে, কি করে দেখবি না?

খালিসা: হু, দেখতে ছিলাম তাে । এখুনি ঘরে আইছি । ভাত তুলে দিসি ।

রহমত: খুব খিদা লাগছে । খাওন দে ।

খালিসা : হ দিতাছি। 

খাওয়া দাওয়া প্রায় শেষের দিকে। এমন সময় মেয়ে দুটো বাড়িতে এল হাসিখুশি মনে। ঘরের ভেতর ঢুকতেই বাবাকে দেখে থমকে দাঁড়াল। বাবার ভয়ে একদম ঘরে ঢুকতে সাহস পেল না। নতুন জামাতে ওদের বেশ ভাল লাগছিল। সুন্দর করে চুলগুলাে বেঁধেছে ওরা। আর লাল টকটকে লিপস্টিক ঠোটে দিয়েছে। তবে ঠোটের চারদিকে লেগেছিল বলে দেখতে বেশ মজাই লাগছিল রহমতের। মেয়েদের চমকে দিয়ে বলল- তােরা এদিকে আই।

দুজনকে দুদিকে বসিয়ে খালিসাকে ওদেরকে ভাত দিতে বলে।

খালিসা: ওরা খেয়েছে।

রহমত: আবার খাবে।

ছেলেকে কোলে বসিয়ে খেতে খেতে আদর করে রহমত। আর মেয়েদের হাত বুলিয়ে বলে- খা মা ভাল করে খা। নিজেকে আজ বড় সুখী লাগছে ওর ।

পরদিন সকাল বেলা ছেলেটার প্রচন্ড জ্বর হয়। সারা শরীর গরমে পুড়ে যাচ্ছে মনে হয়। রহমতের মাথা ঠিক থাকে না। এক এক সময় এক এক জনকে বকা দিচ্ছে। গত বিকালে যদি ছেলেটা একা একা কাদার মধ্যে না খেলত তবে জ্বর আসত না। বেলা ওঠার আগেই রহমত ছেলের জন্য পানি পড়া আনতে যায়। তাদের গ্রাম তাে দুরের কথা আশেপাশে তিনটা চারটা গ্রামেও ডাক্তার নাই । হেঁটে হেঁটে রহমত কাশেম মুন্সির বাড়িতে যায় । মুন্সি খুব ভাল মানুষ। বয়স আশি পার হয়েছে তবুও এই বয়সে সুঠাম শরীর। বাপ দাদার আমল থেকেই তার এই পানি পড়া খেয়ে সবার অসুখ সেরেছে। বেলা ওঠার আগেই ছেলেকে পানি পড়া খাইয়ে দেয় ।

ছেলেটার জ্বর ধীরেধীরে কমে যায়। তবে এরই মধ্যে তিনদিন কেটে গেছে। এই তিনদিন রহমত কোথাও যায় নি। সারাক্ষণ ছেলের পাশে বসে থেকেছে।

তিনদির পর সকালে মাছ ধরতে বের হয় রহমত। সকাল থেকে অঝােরে বৃষ্টি হচ্ছে। আর তারমধ্যে আকাশের প্রচন্ড গর্জন আর বিদ্যুতের চমকানি । খালিসা বাড়ি থেকে বের হতে নিষেধ করলেও রহমত সে কথা একদমই শােনে না।

এসবে অনেক আগে থেকেই অভ্যস্ত সে। এগুলােকে সে ডরায় না। ছাতা নিয়ে বের হয়ে যায় রহমত। সারাদিন বৃষ্টি হয়। খালিসা সারাদিন স্বামীর জন্য চিন্তা করেছে। সন্ধ্যার আগে ব্যাগ ভর্তি বাজার নিয়ে ঘরে ফেরে রহমত। হাঁফ ছেড়ে বাঁচে খালিসা এবারের বষাটা মনে হয় একটু বেশিই। এক নাগাড়ে বৃষ্টি হয়েই চলছে। টানা কয়েকদিন হল। চারদিকে শুধু পানি আর পানি। যতদূর চোখ যায় শুধু পানি চিকমিক করে। রহমতের বাড়ির সামনের রাস্তাটা পানিতে ডুবে গেছে। বাড়ি থেকে বের হওয়াই এখন মুশকিল। 

কিন্তু এর পরও বাড়িতে বসে থাকে না রহমত। বাড়ি থেকে বের হয় । বাড়ি থেকে বের হয়ে সে যা দেখল তাতে ওর চোখ কপালে উঠল । দেখল পাশের তিনচারটা বাড়িতে পানি ঢুকে পড়েছে । বাড়িতে মাচাং এর মত তৈরি করে তারা সেখানে বসে আছে । রহমত ভেবে দেখল যে, তাতে দু এক দিনের মধ্যে ওর বাড়িতেও পানি ঢুকে যাবে।

তাই আর দেরি না করে বাড়িতে আসে রহমত বৃষ্টির মধ্যে ভিজে ভিজে আঙিনায় অনেক উঁচু করে কুঁড়েঘরের মত করে একটা ঘর তােলে। ভেবেছিল এবারে বর্ষায় মাছ ধরে কিছু টাকা জমাবে। কিন্তু সে আশায় গুড়ে বালি। বন্যায় যদি সব ভেসে নিয়ে যায় তাহলে সে একেবারেই নিঃস্ব হয়ে যাবে । দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বলে । আল্লাহ রক্ষা কর ।

দিন দুয়েকের মধ্যে রহমতের বাড়ি ঘরের কিছু সব আসবাবপত্র সবকিছু পানিতে ভেসে যায়। ছােট ছােট কয়েকটা জিনিস নিয়ে কুঁড়ে ঘরে ওঠে । কুঁড়ে ঘরেই থাকা খাওয়া শুরু করে। এলাকায় যে বাজার ছিল সেখানেও পানি ওঠাতে এখন আর বাজার বসে না। তাই পকেটে টাকা থাকলেও বাজার করা হচ্ছে না। এটা ওটা দিয়ে পেট চালায়।

বিকালের দিকে রহমত একটা নৌকা নিয়ে বাড়িতে আসে । সাথে অনেক বাজার। একটা চুলা। আর কিছু শুকনা কাঠ। প্রায় এক সপ্তাহের মত বাজার করে এনেছে। সে । আজ সে অনেক খুশি। ছেলেকে নিয়ে পিঠে চড়িয়ে হাতি ঘােড়া খেলে ।

রহমত বাড়িতে না থাকলে মেয়ে দুটো পানিতে নেমে লাফালাফি ঝাঁপাঝাপি করে । মা নিষেধ করলেও শােনে না। অন্যদিকে ছােট ছেলেটা ও ওদের দেখাদেখি পানিতে নামতে চায়। কিন্তু খালিসা ধমক দিয়ে কোলে করে রাখে। আর বাচ্চাটা ও টেপরেকোর্ডেরের মত এক নাগাড়ে কাঁদতে থাকে ।

ওয়াও, ওয়াও।

রহমত' মাছ ধরতে গেলে খালিসা আর ওর মেয়েরা বসে থাকে না । ওরা ও কুঁড়ে ঘরের উপর থেকে মাছ ধরে। পাঁচা দিয়ে । লম্বা একটা বাঁশের মাথায় সজারুর কাটার মত অনেকগুলাে লম্বা লােহার মত লাগানাে থাকে। পানির উপর কোথাও কিছু নড়ে উঠলে সেখানেই ওটাদিয়ে আঘাত করে। মাছদু একটা পায়। তবে মাছ না পেলেও মাছ ধরার আনন্দটা ঠিকই সবাই মিলে খুব উপভােগ করে। 

আবার রহমত যখন এসে এটা দিয়ে বসে বসে মাছ ধরে তখন ঠিকই বড় বড় মাছ পায় ।

আসলে জেলের চোখ কিনা! পানির নিচেও মাছের চলাফেরা দেখতে পায়। যাকে বলে আই কন্টাক ।

বড় কোন একটা মাছ ধরলে সেটা হাতে নিয়ে ছেলেকে দেখায়।

বাবা, দেহ, বড় মাছ ।

ছােট বাচ্চাটা কথা বলতে না পারলেও ওর অনুভূতিটা বুঝা যায়। কাছে এসে মাছে হাত দিয়ে বলে- উউউ...ইইই...

এভাবে সপ্তাহ খানেক পার হয়। পানি কমা তাে দূরের কথা বরং দিনদিন বেড়েই চলেছে। রহমতের চোখে ঘুম নেই রাতে । সবাই ঘুমায়। আর সে বসে বসে বিড়ি খায় আর পাঁচা দিয়ে মাছ ধরে। খালিসা জেগে ওঠে মাঝে মাঝে মাছ ধরার শব্দে । রহমতকে ঘুমাতে বলে। রহমত ঘুমায় না।

খালিসা: ঘুমাইবা না।

রহমত: না, তুই ঘুমা।

খালিসা: মাছ বেইচা আমাগো এইবার অনেক টাহা ওইচে তাই না ।

রহমত: হরে বউ । তয় বাড়ি ঘর সে সব ভাইস্যা গেল । সবই আল্লাহর ইচ্ছা।

খালিস: চল, ঘুমাবা। রাইত অনেক হইছে ।

রহমত কোন কথা না বলে, হাতের বিড়িটা পানিতে ফেলে দিয়ে শুয়ে পড়ে। প্রায় প্রতি রাতেই খালিসা স্বামীকে এভাবে ঘুমাতে বলে । অবশ্য এ সময় তারা গল্প ও করে। অনেক রকম গল্প, সুখের গল্প, দুঃখের গল্প, হাসির গল্প ।

আজকাল রহমত কুঁড়েতে বেশ বড় বড় মাছই ধরছে রাতে বসে বসে। পাঁচা দিয়ে কিভাবে মাছ ধরতে হয়। এটা শিখিয়ে দেওয়ার জন্য খালিসা তার স্বামীকে অনুরােধ করে। রহমত খালিসাকে শিখিয়ে দেয়। কিন্তু খালিসা একটা মাছ ও তাক করতে পারে না। রহমত শুধু তার খােকসা ডাল দিয়ে মাজা বত্রিশ পাটির দাঁত বের করে হাসে। খালিসা এতে রাগান্বিত হয়। তবে এই রাগ মিষ্টি রাগ । ভালবাসার রাগ।

পরদিন মাছ ধরে আসার সময় রহমত ছেলের জন্য একটা ফতুয়া কিনে আনে । তবে মেয়েদের জন্য কিছু আনে নি বলে ওরা গাল ফুলিয়ে থাকে । 

রহমত: তােরা রাগ করিস না মা। তােদের ও দিমু ।

মেয়েরা মুখে কিছু বলার সাহস পায় না। তবে ওদের মুখ দেখে রহমতের বুঝতে বাকি রইল না যে মেয়েরা তার প্রতি খুব রাগ করেছে।

রাতে ঘুমানাের সময় রহমতের ছেলে ওর মুখের মধ্যে মুখ লাগিয়ে ও ও ও করে । কাজটা করে সে খুব মজা পাচ্ছিল। আর রহমত ও ওর শরীরে কাতুকুতু দিচ্ছিল । নতুন জামা পেয়ে ছেলেটা আজ খুব খুশি। মাঝে মাঝে বােনদের উপরে যেয়ে পড়ে যাচ্ছে। খালিসাও এটা দেখে মজা পাচ্ছিল।

রাতে খালিসা স্বামীর মাছ ধরার সময় পাশেই ছিল । ছেলেমেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে । রহমতের হাত থেকে পাঁচাটা নিয়ে এখানে সেখানে ফেলছিল খালিসা । কিন্তু হতাশ হয়ে উপরে তুলে দেখে কিছুই নেই ।

অন্ধকার রাত্রে ওরা দুজন ভালই গল্প করছিল ।

বড় মেয়েটা না জানি কেমন আছে । সন্তান সম্ভবা মেয়েটা। বন্যা নেমে গেলেই মেয়েটাকে দেখতে যাবে রহমত আর খালিসা । এমন সময় ঝুপ করে একটা শব্দ হল পানিতে। প্রথমে তারা বুঝতে পারল না।

তারপর আবার একটু পানির নড়াচড়া শােনা গেল। ওরা ঠিক যে পাশে বসে ছিল তার বিপরীত পাশেই। খালিসা পেছন ঘুরে উঠে এসে পানির এক জায়গায় আন্দাজ করে পাঁচাটা দিয়ে সজোরে আঘাত করে । ওর কথা শুনে মনে হল সে খুব খুশী।

খালিসা: এইবার মাছ পাইছি ।

পানি অবধি যখন টেনে পাঁচাটা ওঠালাে তখন ভারিটা কমই লাগছিল। পানির উপরে উঠাতে অনেক বেশি ভারি লাগছিল ।

খালিসা: বড় মাছ পাইছি । একা তুলবার পারছি না। আহ এদিকে ।

রহমত এগিয়ে এসে অন্ধকারে দুজন মিলে পাঁচাটা টেনে উপরে তােলে। রহমত ততক্ষণে দিয়াশলায়ের কাঠিতে আগুন জালিয়েছে মাছটা দেখার জন্য ।

আগুন জ্বলে উঠতেই তারা দেখল মাছটা তাদেরই আদরের ছেলে। পাঁচার কাটাগুলাে তার বুক ভেদ করে পিঠ দিয়ে বের হয়ে গেছে। মুহূর্তের মধ্যে আর্তনাদ করে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে খালিসা।

খালিসা: এ আমি কি করলাম......

রহমতও হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। ওদের চিৎকারের কান্না শুনে পাশের বাড়ির লােকেরাও লণ্ঠন নিয়ে চলে আসে ওদের কাছে । এসে জানতে পারে ঘটনাটা।

বাচ্চাটাকে মাঝখানে রেখে সবার শেষে ঘুমাতে খালিসা। খালিসা উঠে আসাতে ঘুমের মধ্যে ছেলেটা নড়াচড়া করাতে পানিতে পড়ে গেছে । আর খালিসা মাছ ভেবে সেটাকে শিকার করেছে অন্ধকারে। খালিসাকে সবাই সান্তনা দিচ্ছিল। কিন্তু ছােট বাচ্চাটার মুখের দিকে তাকিয়ে কেউই কান্না ধরে রাখতে পারছিল না। রহমতের মেয়েরাও কাঁদছে হু হু করে..

হেরিকেন ও লণ্ঠনের লাল আলােয় চারদিক আলােকিত হয়েছে ।

পানিতে সেই আলাে পড়ে এক সােনালী চিকচিক আভার সৃষ্টি করেছে। আর লাল রক্ত সেই আভার সাথে মিশে কলকল শব্দে বয়ে চলেছে এক অজানা গন্তব্যে।

ফজরের আযান হয়ে যাচ্ছে। আযানের সাথে খালিসার কান্নার শব্দও মিলে যাচ্ছে। ধীরে ধীরে। এক দৃষ্টিতে সে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে আছে। তার মুখে কোন কথা নেই। শােকে পাথর হয়ে গেছে সে। কেউ কাছে এসে বাচ্চাটিকে দেখতে এলে সে হাত দিয়ে ইশারা করে বলে-

আমি বড় মাছ পাইছি, দেহেন.....
বড় মাছ........

১৮ অক্টোবর-২০১৪
বড়

কোন মন্তব্য নেই

Blogger দ্বারা পরিচালিত.