প্রতিক্রিয়া (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
লেখক
প্রতিক্রিয়া
এক,
সুকু ডান হাতের তর্জনী উঁচু করে, রাজনৈতিক মঞ্চের ভাষায়
প্রায় চিৎকার করে বলে, বিশ্বাস করি না। নিষ্ঠার মূল্য নেই একথা বিশ্বাস
করবে কেউ? পৃথিবী জুড়ে এখনও কিছু কিছু সৎ আর নিষ্ঠাবান মানুষ আছে বলেই আজও
স্বপ্ন দেখে মানুষ ।
কিসের, সুখের? হিঃ হিঃ হিঃ টিপ্পনী কাটে জাবেদ। হিঃ
হিঃ করে হাসে। হাসিতে তাচ্ছিল্যের শব্দ এবং চোখে মুখে সত্য ভাষণের
প্রত্যয়। ঠিক তুরুপের শীর্ষ পর্যায়ের তাস হাতে থাকার মতাে উচ্ছলতা।
তুই
একটা বােকা। সৎ মানুষ খুঁজতে গেলে তাের ছেড়া কম্বলের অবশিষ্ট লােমও খুঁজে
পাওয়া যাবে না। একটা গল্প শুনিসনি, সেই যে, যে কাপড় কোনাে দিন কেউ
দেখেনি। সেই কাপড় দিয়ে রাজার পােশাক তৈরি করতে হবে দর্জির, না হলে গর্দান
যাবে। অবশেষে রাজাকে ন্যাংটা করে অদৃশ্য পােশাক অবশ্যই দেখিয়ে ছিল দর্জি।
তােমার সততা আর নিষ্ঠা এমনি অদৃশ্য হতে হবে দোস্ত। অপেক্ষা করাে। হাঃ হাঃ
করে এবার বিজয়ের গৌরবে হাসে জাবেদ। সুকুকে কিছুই বলার সুযােগ দেয় না ওরা
সবাই। জ্ঞানীর কদর নেই আর সততার মূল্য নেই বিষয়টি তাদের কাছে পরিষ্কার।
প্রায় চিরসত্য। তাই সুকুর নিষ্ঠা আর সততাকে ওরা স্রেফ বােকামি বলে সময়ে
অসময়ে জ্বালাতন করে সুকুকে। রমেন সিগারেটে একটা লম্বা টান দিয়ে ধোয়ার
রিং ওড়ায় আকাশে। বিজ্ঞের মতাে হেসে বলে,
সুকুকে সৎ থাকতে দে, উনি এদেশের
গাধাগুলােকে ঘােড়া, ঘােড়াগুলােকে হাতি, আর হাতিগুলােকে ডায়নােসর্স
বানিয়ে ছাড়বেন, তােরা দেখিস। হিঃ হিঃ হিঃ...
আবার সম্মিলিত হাসির কোরাসে
সুকুর প্রতিবাদের সব ভাষার অকাল সমাপ্তি ঘটে। সুকু বন্ধুদের মনােভাবের
প্রতি করুণা করে মনে মনে।
ততক্ষণে
বােটানিক্যাল গার্ডেনের পাশের পুকুরটার ধারে বসে পড়েছে জাবেদ । সুকুর হাত
ধরে কাছে টানে রমেন। শিশির কদম গাছটার গায়ে হেলান দিয়ে বসে। ঠিক তখনই
মাথার উপরের কদম ডালে বসা ঘুঘু পাখি করুণ সুরে ডেকে উঠে ঘুঘু- ঘুগ।
ঘুঘু-ঘুগ সুকু চোখ বুজে উপলব্ধি করে ঘুঘুর ডাকে কোথায় যেন একটা হতাশা,
একটা দুর্বোধ্য অনুভবের প্রাচীর ভাঙা কষ্ট। কোথায় যেন একটা প্রচ্ছন্ন
স্বপ্নের জ্বালা। আবেশে চোখ বন্ধ করে সুকু।
শিশির দ্যাখ, শালা সুকু
ঘুমিয়েছে। খ্যাক খ্যাক করে হাঁসের মতাে রহস্যময় হাসি হাসে জাবেদ আবারও।
সবাই চুপ, উনি এখন সােনারগাঁ হােটেলের ভিআইপি রুমে অবকাশ যাপন করছেন। তােরা
ডিসটার্ব করিসনে। চিৎকার করে বলে রমেন ।
সেরেছে রে! দু'হাতে
বায়নােকুলারের মতাে ভঙ্গি করে সবার মনােযােগ আকর্ষণ করে শিশির এবং আবার
বলে,
এবার দারােগা আসছে। মজা টের পাবি।
রমেন শিশিরের দৃষ্টি অনুসরণ করে।
নীল শাড়ির আঁচল বাতাসে উড়িয়ে প্রজাপতির মতাে নাচতে নাচতে আসছে ছুটি,
দেখে রমেন চিক্কার দেয় উল্লাসে। রমেন দাড়িয়ে যায়, দৃষ্টি ঘুড়িয়ে আনে
উপস্থিত সবার মুখের উপর দিয়ে। তারপর চুল ধরে টেনে তুলে সুকুর অলস দেহ,
বরশিতে গাঁথা মাছের মতাে ।
এই যে স্যার, উঠুন, বিভন্ন মহিলা হাকিম
ওয়ারেন্ট নিয়ে নিজেই আসছেন। আসামী ঘুমিয়ে থাকলে চলবে? রমেনের ডাকে চোখ
খুলে সােজা হয়ে বসে সুকু।
ওরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিজ্ঞান
বিভাগের ছাত্র। ক্লাসের ফাকে সময়ক্ষেপণ করতে এসেছে বােটানিক্যাল গার্ডেনে।
সুকু সৎ নিষ্ঠাবান এবং মেধাবী। তার নিষ্ঠা বন্ধু মহলে সমালােচিত হয়
এভাবেই । সুকু নীরবে সহ্য করে সবই। আর ক্রমাগতভাবে প্রতিটি পরীক্ষাতেই
অবলীলায় প্রথম হতে থাকে।
জাবেদ, শিশির আর রমেন বন্ধু হলেও ঠিক উল্টো
চরিত্রের বৈশিষ্ট্য লালন করে নিজেদের মনে। প্রচণ্ড চৈত্রে 'ছুটি' সুকুর
জীবনে স্নিগ্ধ বারিধারা। বন্ধু মহলের আর সবার একমাত্র আকাক্সক্ষা যেভাবেই
হােক ধনী হতে হবে। তাদের ধারণা সততা এবং নিষ্ঠার কোনাে প্রয়ােজন এ যুগে
নেই। অবৈধ পথে হলেও অর্থ উপার্জন করতে পারাটাই এখন মানুষের জীবনের একমাত্র
লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। কারণ, সমাজ এখন অসৎ কিন্তু ধনীদের খুবই শ্রদ্ধা করে। আর
ছুটি তাদের সবার লক্ষ্যের কেন্দ্র বিন্দু, কিন্তু সুকুর জীবনে ছুটি একখণ্ড
মেঘের মতাে সান্ত্বনা।
এই যে স্যার, অনেক কষ্টে ঘুম ভাঙালাম, এবার কি আবার
মনে মনে পড়া মুখত করা শুরু করলেন? নাকি কবিতার ছন্দ নিয়ে... ব্যঙ্গ করে
জাবেদ এবং আবারও বলে,
কিন্তু লাভ নেই দোস্ত লেখাপড়া করে যে গাড়ি চাপা পড়ে সে'। দেখে নিও ঝলমলে বাড়ি, চকচকে গাড়ি, আর সুন্দরী নারী আমার ঠিকই থাকবে তােমার সত্যতা আর নিষ্ঠা ধুয়ে খাওয়ার মতাে বােকা আমি নই ।
নীল শাড়িতে জড়ানাে ছুটির তন্বী
দেহ ক্রমান্বয়ে স্পষ্ট হয়ে আসে। কলের পুতুলের মতাে চোখ তুলে তাকায়
সুকু। তার প্রাণের ভেতর চৈত্রের হাওয়ায় শুকনাে পাতা উড়ে। অজস্র ফুলের
সুবাসে হৃদয় ভরে উঠে। সে মনে মনে ভাবে হােক না সে বােকা। পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ
সম্পদ ছুটি তাে তারই আছে। চাওয়ার আর কিছুই নেই। তার। তার নিষ্ঠা সততা এবং
মেধাই তাে ছুটিকে কাছে এনে দিয়েছে তার।
সেদিনের কথা মনে পড়ে সুকুর—তখন
কলেজ জীবনের শেষপর্ব। দোতলায় করিডােরে দাঁড়িয়ে ছিল সুকু। চারিদিকে
দুপুরের নিস্তব্ধতা। অনেক দিন বাড়ির খবর জানে না সুকু। ছােট বােন আর মা
বাড়িতে। সকাল থেকেই মনটা ভারাক্রান্ত হয়ে আছে তার। ইচ্ছে হচ্ছে বাড়ি
যেয়ে দেখে আসে তাদের। বাবা নেই সেই ছােট বেলা থেকে, শুধুমাত্র নিজের
ঐকান্তিক ইচ্ছা আর নিষ্ঠা অনেক কষ্টের ভেতর দিয়ে এগিয়ে যেতে সাহায্য
করেছে তাকে সামনের দিকে। অসহায় মা তার সফলতার জন্য পাথর চোখে চেয়ে আছেন
ভবিষ্যতের দিকে। পথ কতদূর জানে না সুকু।
শুনুন...
একটি বাশির মতাে কণ্ঠ!
নাকি কোনাে গানের কলি? হবে হয়তাে। এমন হয় বলেই এ ধরনের দুপুরগুলো মধুর।
স্বপ্নের মতাে।
সুকু দূরে রেডিও বাংলাদেশের ট্রান্সমিটারের উপর দিয়ে উদাস
আকাশ দেখে। ইথারে নিজের মনের কথা মিশিয়ে দেয় এবং ভাবে বাঃ কলেজের
করিডােরে এতাে মধুর বাঁশি বাজায় কে?
শুনছেন...। আমি আপনাকেই ডাকছি।
আবারও
বাঁশি বাজে । নাকি কোকিল ডাকছে? সুকু ভাবে কেউ কি তাকে পেছন থেকে ডাকে?
পাখি? নাকি অদৃশ্য কোনাে পরী? শাড়ির খসখসে শব্দের সংগে একটা মৃদু পদচারণার
অস্থিরতায় পেছনে ফিরে চায় সুকু। হ্যা, সেইতাে। যে মেয়ের পায়ে ধুলাের
স্পর্শ লাগে না কোনাে দিন, সেই মেয়েটি তাকে ডাকবে কেন? বন্ধুদের মুখে অনেক
আলােচনা শুনেছে তার প্রায়ই । অহংকারী, খান্ডারনী, দজ্জাল, দারােগা এবং
মিষ্টি মেয়ে, এ ধরনের অ বিশেষণে কণ্টকিত ছুটি নামের এ মেয়েটি।
আজ
প্রথমবারের মতাে তার অতি কাছে থেকে বিশেষণগুলাে মিথ্যা মনে হয়।
মেয়েটির
কাছাকাছি আসার সম্ভাবনা তার যে কোনাে দিনই হবে না এ ব্যাপারে অন্ততপক্ষে
সুকু নিশ্চিত ছিল। তাই এ কিংবদন্তি মানবীর এমন মধুর কণ্ঠের আহ্বান সুকুকে
বিহব্বল করে। মনে মনে ভাবে এমন কণ্ঠ যার সেকি......
এই
যে শুনছেন...
আবারও মধু বর্ষিত হয় সুকুর অনভ্যস্ত কানে। ঘুরে দাঁড়ায়
সুকু। কোনাে কথা বলার সুযােগই দেয় না ছুটি।
কি ব্যাপার, আমার অস্তিত্বই
অস্বীকার করে ফেলছেন? হ্যা, আপনাকেই ডাকছি। বুঝেছেন ?
সুকুর মনে পড়ে
দীর্ঘদিন ধরে এ মেয়েটি অসম্ভব দম্ভ ভরে ক্লাসে এসেছে। চারদিকের গুন
গ্রাহীদের হৃদয় যন্ত্রণার নীল বিষে জর্জরিত করে শুধু আকাশের দিকে চেয়ে পথ
চলেছে মেয়েটি। তার জুতাের শব্দ ছাড়া আর কিছুই পায়নি কেউ কোনাে দিন। সেই
অপরূপ দাম্ভিক মেয়েটি আজ...
সুকু হা-না, যা হােক ইত্যাদি ধরনের একটা
উত্তর দিয়েছিল সে দিন। মনে পড়ে আরও অনেক কিছু। তবে তারপর প্রায়ই
করিডােরে তাদের আলাপ হতে থাকে । অবশেষে মনে হতাে করিডােরটা যেন ষড়যন্ত্র
করে প্রতিদিনই ওদের সাক্ষাৎ ঘটানাের জন্য ব্যস্ত হয়ে আছে। করিডাের মনের
কথা বােঝে কিভাবে? আশ্চর্য হবার পালা শেষ হলে সুকু জিজ্ঞাসা করে—
কিন্তু...
হ্যা, এই নিন ।
হাতের দামি ডায়েরির একটা পাতা ছড়-ছড় করে ছিড়ে নেয়
ছুটি। তারপর খস- খস করে কলমের আঁচর কাটে তার উপর। এগিয়ে দেয় সুকুর দিকে।
এতে আমার ঠিকানা লিখা আছে। আজকেই আপনার সংগে আমার প্রথম পরিচয় । তবু আজই
আপনাকে আমি আমার জন্য কষ্ট দিচ্ছি। আমি আপনার আচরণ লক্ষ্য করেছি দীর্ঘদিন।
মনে হয়েছে আপনাকে বিশ্বাস করে কষ্ট দেওয়া যায়। তাই সাহস পেলাম।
সুকু
ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। স্বপ্ন দেখছে না তাে সে? অনেক শক্তি সংগ্রহ করে
কিছু একটা বলতে চেষ্টা করে সে, কিন্তু তার আগেই ছুটি তার সুন্দর মুক্তোর
মতাে দাঁতে কাঁচ ভাঙ্গা হাসি হেসে বলে,
আপনাকে আমাদের বাসায় আসতে হবে।
আগামী পরশু রাতে। আমি বাবার সংগে ঢাকা যাবাে আজ। বাবা লন্ডন যাচ্ছেন,
বিবিসিতে চাকরি নিয়ে। তাকে বিদায় জানিয়ে আমি ফিরে আসবাে। এ সময়গুলাের
ক্লাস নােট আমি পাবাে না।
আপনি বাসায় এলে পরিচয় ও পড়াশুনা দুটোয় দৃঢ়
হবে। আপনাকে কষ্ট দিতে আমার খুব ভালাে লাগছে। ইচ্ছে হলে প্রতিশােধ নিতে
পারেন। আমার আপত্তি নেই।
ছুটির হাসিতে এবার চাঁদের আলােয় স্নিগ্ধতা। পাতার
গায়ে চিকমিক লুকো চুরির বিচ্ছুরণ। সুকু হৃদয়ে অদ্ভুত শিহরণ অনুভব করে। সে
ঐ মায়াময় চোখ দুটি হতে নিজের দৃষ্টি সরিয়ে নিতে চেষ্টা করে। কিন্তু
কেবলই তার মনে হয় পৃথিবীর সাড়ে
চারশ’ কোটি মানুষের ভেতর সবচেয়ে যে দুটি চোখ সুন্দর, সে চোখে এক অদ্ভুত
মায়া জড়ানাে আছে তার জন্য। সুকু গভীর আঁধারের ভেতর স্বপ্ন দেখে। আর তখনই
তার জীবনের স্তরে স্তরে এক সুগভীর কালাে দাগ কেটে যায় চিরতরে । সুকু অবুঝ
মাদকতায় মাতাল হয় নিজের অজান্তে।
আসবেন অবশ্যই।
ছুটি আর কথা না বাড়িয়ে
সামনে এগােয়। হাতের লিখা কাগজটির দিকে ততােক্ষণে মনােযােগ দেয় সুকু------
রিজভী
আহম্মেদ
আঞ্চলিক পরিচালক
রেডিও বাংলাদেশ, কাজিহাটা, রাজশাহী।
চোখ ফিরিয়ে
সুকু লক্ষ্য করে ছুটির নীল শাড়িতে জড়ানাে সুন্দর দেহটি ততক্ষণে দোতলার
সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত অপসৃত হচ্ছে।
হাতে হ্যাচকা টান অনুভব করে সুকু। ছুটির
রুদ্র মূর্তি দেখে হাসে সে এবং বিনা বাক্য ব্যয়ে উঠে দাঁড়ায়। শিশির,
রমেন জাবেদ ততক্ষণে রণেভঙ্গ দিয়েছে। তবে নতুন উপসর্গ পেয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে
উজ্জীবিত হয় জাবেদ...।
এই যে, মিস অগ্নিবীণা। আমাদের কি মানুষ বলে মনে
হচ্ছে না? নাকি আমরা বিড়াল শিয়ালের জাত।
ছুটির মুখের সবুজ লাবণ্য গাঢ়
হয় । হাসলে ছুটির চোখে অপরূপ আলােছায়া মাখামাখি করে। তখন কাল বৈশাখীর
আশংকা দূরীভূত জেনে সবাই স্বস্তি পায় । জাবেদ আবার সাহস সঞ্চয় করে বলে,
ম্যাডাম সুকুর সততার ছবক কি আপনি দিয়েছেন ? দয়া করে অসতের গাড়ি চাপার
লক্ষ্যবস্তু ওকে আর বানাবেন না। একে ক্ষ্যামা দিন।
হিঃ হিঃ করে হাসে জাবেদ।
শিশির নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে সেদিকে । ছুটি সে হাসিতে যােগ দেয় এবং
বলে,
জ্বি না, আমার জন্য নয়। তিনি নিজেই যথেষ্ট বােঝেন। তবে সততা আর
নিষ্ঠার অপরাধটা কোথায়? সৎ মানুষের কি কোনাে উপায় নেই? আপনারা যাই বলুন
এই বােকা লােকটিই একটা বিশাল সমুদ্র আমার কাছে। আমি নদীর মতাে তার সাথেই
একাকার থাকতে চাই। এবার বােধ হয় আমাকেও বােকা বলবেন?
না, শিশির হেসে উত্তর
দেয় । মেয়েরা ভালােবাসে কবিকে, কিন্তু বিয়ে করে ইঞ্জিনিয়ারকে। কারণ কি
জানেন?
জানি। অর্থের কথাই যদি বলতে হয়, তবে সে অর্থ প্রয়ােজন অন্য কোনাে
মেয়ের। ছুটির নয়। ছুটি আগুন, তাই তার কাছে খাঁটি সােনাই ঠাই পায় ।
অর্থপূর্ণ হাসির রেখা ফুটে উঠে ছুটির মুখে।
সুকুর
মনের ভেতর তখন কবুতরের উষ্ণতা, হৃদয় জুড়ে সবুজ বনের হিল্লোল, কোকিলের
ডাকে অজানা বাঁশি বাজে দিগন্তব্যাপী। মনের ভেতর একটি প্রশান্ত গুঞ্জনের
অনুরণন হতে থাকে অবিরত, ছুটি ছুটি ছুটি ছুটি...।
তারা দ্রুত হাঁটে ক্লাসের
উদ্দেশে।
দুই.
ক্লান্ত দেহে ঘরে ফিরে সুকু প্রতিদিনের মত । ঘরের নির্জনতার
এক অন্যরূপ অনুভব করে সুকু আজও। তবে ছন্দ পতন ঘটে একটু পরেই। টেবিলে
বিশ্ববিদ্যালয়ের নামাঙ্কিত সুদৃশ্য খাম রেখে গিয়েছে বেয়ারা। এখনও
দুপুরের খাবার খাওয়া হয়নি, কিন্তু সন্ধ্যার আহ্বান বিকেলের রােদকে এরই
মধ্যে ম্লান করে দিয়েছে। ছোঁয়াচে রােগের মতাে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীত তার
মনকে ভারাক্রান্ত করে তােলে । স্মৃতিগুলাে ভেসে উঠে একে একে। সেই ক্লাস,
বােটানিক্যাল গার্ডেন, মুন্নজান হল, জাবেদ, রমেন, ছুটি সব কোথায় আজ?
বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ পরীক্ষার পর সুকু এলাে কলেজ শিক্ষকতায়। জাবেদ
ঠিকাদারি পেশায় নিয়ােজিত হলাে। শিশির আমেরিকায় সেটেল করলাে আর ছুটি তার
বাবার নতুন কর্মস্থল লন্ডনে চলে গেল। তাদের যােগাযােগ ক্ষীণতর হতে হতে এক
সময় বন্ধ হয়ে গেল। তারপর দীর্ঘকাল ছুটির কোনাে খবরই সংগ্রহ করতে পারেনি
সুকু। জীবনের অনিবার্য দিনগুলাে একাকী কেটে গেল। সেদিনের ছুটি আর কোনদিনই
তার হলাে না।
নিজেকে লুকিয়ে ফেললাে সুকু আপন ভুবনে। নিসর্গের মাঝে
সান্ত্বনা খুঁজতে চলে এলাে এই পার্বত্য জেলা রাঙ্গামাটির এক নির্জন কলেজে
শিক্ষকতা পেশা নিয়ে।
খাম খুলে ভেতরের কাগজে মনযােগ দেয় সুকু। এক ঝলক রক্ত
ছল-ছল করে উঠে হৃদয়ে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের
পুরাতন ছাত্রদের পুনর্মিলনী । চিঠিতে দিন তারিখ সব উল্লেখ করে অনুষ্ঠানে
যােগ দেয়ার আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছে।
জানালার পর্দা তুলে দূরের সবুজ
পাহাড়ে লতাপাতার নির্বাক ভাষায় নিজের অসহায় অবস্থার অন্বেষণ করে সুকু।
ছুটি তার প্রাণের উষ্ণতার চেয়ে বিদেশের বৈভবকে অধিকতর শ্রেয় মনে করলাে।
সুকু ভাবে আসলেই সে বােকা। বােকা না হলে কি আজ এমন জীবন বেছে নিতে হয়
তাকে।
তিন,
মিলনায়তনে পুনর্মিলনীর বর্ণাঢ্য আয়ােজন। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা
উৎসবের আয়ােজনে মুখর। অনেক পরিচিত মুখের ভিড়ে স্মৃতির সাগর খুঁজে মুক্তো
আহরণে ব্যস্ত
সবাই। সুকুর কোনাে তাড়া নেই। তার চঞ্চল চোখ চারদিকে ছুটে যায় বারে বারে
এক আকাক্ষিত মুখের সন্ধানে। প্রত্যাশার আগুন তাকে অস্থির করে রাখে। প্যারিস
রােডের ইউক্যালিপটাস গাছ এবং বােটানিক্যাল গার্ডেনের সেই কদম গাছ এখন আগের
মতাে নেই। চারিদিকের পরিবর্তনের হাওয়া। সবুজ গাছের উঠোন জুড়ে নবীন তরুণ
তরুণীদের পদচারণা বারবার আনমনা করে সুকুকে। একটা হতাশার অন্ধকার ক্রমে
ছেয়ে আসে তার চারিদিকে। সেকি আসবে না? সুকু একে একে পুরাতন পরিচিত
জায়গাগুলাের অবস্থান নির্ণয় করে ধীর পায়ে হাঁটে। সে স্থানগুলাে দেখে
একাকী। সেই কদম গাছটি এখন নেই। পুকুরের তীর ঘেঁষে সারি- সারি গাছগুলাে
ঝােপ-ঝাড়ে পূর্ণ। পাশের শিউলী গাছটি অনেক উঁচু হয়ে পূর্ণতা পেয়েছে
জীবনের। সুকু ভাবে সবারই আপন আপন পথ আছে। কিন্তু তার? তার পথের কোনাে
নিশানা নেই—তার জীবনের দিশা লক্ষ্যহীন চৈত্রের বাতাসের মতাে।
পুকুরের ধার
থেকে উঠে দাঁড়ায় সুকু। ছুটির আগমনের কোন সম্ভাবনা দেখছে। সে। পুনর্মিলনীর
মাহেন্দ্রক্ষণের আকর্ষণ হারায় সে। সিদ্ধান্ত নেয় ফিরে যাবে। এখনই
কর্মস্থলে। হাঁটা শুরু করে সে।
ঠিক তখনই শাে-শাে শব্দে একটা বিলাসবহুল
মােটর কার তার পাশ দিয়ে ছুটে যায়। নীল শাড়ির আড়াল থেকে একটি পরিচিতি
মসৃণ মােমের মতাে সাদা হাত আঁকড়ে ধরে আছে সঙ্গের পুরুষটিকে। সুখ আর
সচ্ছলতার তৃপ্তিতে উজ্জ্বল ওদের আচরণ। সুকু নির্বাক চেয়ে দেখে পৃথিবীর রং।
জীবনের অন্যরকম অনুভূতি বাতাসের গা ছুঁয়ে লেপ্টে থাকে সুকুর চোখে।
দম্পতিকে চেনা চেনা মনে হয় তার এবং নিঃসন্দেহে অনুভব করে ঐ মেয়েটিই তার
ছুটি। জাবেদ ছুটির হাত ধরে এগিয়ে আসে,
দোস্ত গতকাল লন্ডন থেকে এসেছি। ছুটি
কোনাে ভাবেই ছাড়লাে না। বুঝতে ৪/৫টা দেশে ব্যবসা, অত সময় কই? তুমি রাগ
করাে না দোস্ত, লন্ডনে থাকতে ছুটির বাবাই আমাকে বিয়ের প্রস্তাব দেয় ।
ছুটি আপত্তি করেনি। তাই বিয়েটা হয়ে গেলাে। তােমার খবর কি দোস্ত...?
সুকুরে মনের ভেতর কষ্টেরা কাঁদে নিঃশব্দে। তবু হাসে সে। লম্বা পা ফেলে
সামনে এগিয়ে যেতে যেতে বলে,
একটা অখ্যাত কলেজের মাস্টারের কুশল জানতে চাও?
কোনাে প্রয়ােজন নেই। তার । নিষ্ঠাবানের খবর কেউ রাখে না। জাবেদ স্থির
দৃষ্টিতে তার মুখের দিকে চেয়ে থাকে। ছুটির মুখে কোনাে কথা নেই। সুকু হাত
তুলে বিদায় জানায় এবং ছুটির গভীর দৃষ্টির সামনে নিষ্ঠা আর সততার দৈন্য
নিয়ে অবশ পা দুটি দেহের সমস্ত শক্তি দিয়ে আবারও টেনে তুলতে চেষ্টা করে।




কোন মন্তব্য নেই