মুক্তিযোদ্ধা (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
লেখক
![]() |
নাজমুল হক
মুক্তিযােদ্ধা
সকালের প্রথম নরম
রােদ মাটি ছোঁয়ার অনেক আগে জাল নিয়ে বের হয় সলিম মাঝি, প্রতিদিনের
মতাে। শক্ত দড়ি দিয়ে মাজায় বেঁধে নেয় খলুই। গায়ে গেঞ্জির মতাে করে
পেঁচিয়ে নেয় একটি পুরানাে গামছা। বহুদিন হলাে তার শেষ জামাটি ছিড়ে
গিয়েছে, আর কেনার সামর্থ্য হয়নি।
কানাইছড়া বিল পিছনে ফেলে কাকডাঙ্গা
পর্যন্ত জাল ফেলতে ফেলতে এসেছে। সে। আকাশের দিকে তাকিয়ে বেলা অনুমানের
চেষ্টা করে সলিম মাঝি । সকালের আমেজ আর নেই। সূর্য প্রায় মাথা ছুঁই ছুঁই ।
আজ মাছ ধরা পড়ছে না জালে, অথচ হাটবেলা হয়ে এলাে। মাছ বিক্রির পর চাল,
তেল, লবণ কিনতে হবে। না হলে উনুনে হাঁড়ি উঠবে না। উচ্ছন্নে। যাওয়া বাড়ির
কথা মনে হতেই বেচারি মরিয়মের মলিন শীর্ণ মুখখানি আবার মনে পড়ে সলিমের...
মুক্তিযুদ্ধের শেষ। বীরদর্পে গ্রামে ঢুকেছে সলিমদের দল। রাইফেল হাতে তাদের
দেখে বিস্ময়ে অভিভূত কিশােরী মরিয়মের গভীর চোখে ভালােবাসার রৌদ্রছায়া
দেখে সলিম, প্রথমবারের মতাে। তার কিছুদিন পর মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ী সলিম জয়
করে ঘরে নিয়ে আসে মরিয়মকে। রং বেরংয়ের দিনগুলাে আজও রােমাঞ্চিত করে
তাকে।
খ্যাঁচ করে উঠে সলিমের মনের ভেতরটা। বাড়িতে আট বছরের কন্যা মুক্তি
সাত দিন হলাে জ্বরে শয্যাশায়ী। আজ সারারাত নিঃসাড় হয়ে পড়ে থাকতে দেখেছে
সলিম। নিয়মিত উপােস দিতে দিতে মরিয়মও কাহিল হয়ে পড়েছে। বেচারি মরিয়ম!
নিজে নিজেই আবারও উদাস হয়ে যায় সলিম। কাঁচা হলুদের মতাে রং, কলা গাছের
কচি পাতার মতাে লাবণ্য আর মেঘের মতাে চুল ছিল মরিয়মের ।
ফেলে আসা দিনগুলাে
সাদা মেঘের মতো মনের আকাশে উড়তে থাকে। মরিয়ম এলাে উঠোন জুড়ে ঠিকই,
কিন্তু সব ফিকে হয়ে গেল অসময়ে । একটা নিকানাে উঠোন। একটুকরাে জমি, দুটো
বলদ আর একটি ফুটফুটে সন্তান এই সামান্য চাওয়াটুকুও তার পূরণ হলাে না।
আবারাে পানি হতে মাছ শূন্য জাল উঠে এলাে । বিরক্ত হয়ে জাল মাটিতে ফেলে
দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়ে সলিম। পেটে চো চো ক্ষিধে । প্রায় দু’দিন গরম
ভাতের সাক্ষাত মেলেনি। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করতে লজ্জা হয় তার। অভিমানও।
তার এ অবস্থার জন্য দায়ী তাে আল্লাহ নয়। মুক্তিযুদ্ধে যাওয়াই ছিল তার
অপরাধ । আগে বুঝতে না পারলেও এখন পরিষ্কার বুঝে সে। রাজাকার লম্পট আর
প্রতারক লােকগুলােই এখন দেশের মাথা।
বাজারের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়ায়
সলিম । গদি ঘরের সামনে দুটি চেয়ার পেতে বসে আছে আয়েন উদ্দিন ব্যাপারি আর
থানার বড় দারােগা। দামি সিগারেটের মৌ মৌ গন্ধে শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠে।
আয়েন উদ্দিন ব্যাপারি ভােটে দাঁড়িয়েছেন। তার প্রস্তুতি চলছে। মন্ত্রী
হবার না কি খুব সম্ভাবনা।
আজ মাছের বাজারে প্রচণ্ড ভিড়। হাতের খলুইয়ের
দিকে তাকায় সলিম। এক পােয়র সামান্য কিছু বেশি মাছ খলুয়ের তলায় গড়াগড়ি
খাচ্ছে। নিজের উপর প্রচণ্ড ঘৃণা হয় সলিমের।
বাহারী পাঞ্জাবি গায়ে দামি
সিগারেট হাতে গর্বিত আয়েন উদ্দীনের আগের চেয়ে অনেক জেল্লা বেড়েছে। আর সে
নিজে নেড়ী কুত্তার মতাে শুধু শুকিয়ে যাচ্ছে দিন দিন। অথচ এই আয়েন
উদ্দীন একদিন সিনেমার টিকিট কালােবাজারি করতাে। একাত্তরে হানাদারের দালালী,
নারী সাপ্লাই আর মুরগির কন্ট্রাক্টরি করে রাতারাতি টাকার পাহাড় তৈরি করে।
এ সকল ভালাে ভালাে কাজের পুরস্কার হিসাবে এক সময় রাজাকারের কমান্ডার বনে
গেল। সলিম মাঝি তখন নৌকায় ব্যবসা করতাে।
ঘাটের সবচেয়ে বড় নৌকার মালিক
সে। সাতকুলে কোন আপনজন নেই। সপ্তাহে সপ্তাহে মাল কেনা-বেচা করতে ঢাকায়
যেতে হয়।
চারিদিকে খুন, নারী নির্যাতন, এ সব দেখে প্রতিরােধের আগুন জ্বলে।
উঠলাে মনে।
তারপর এক রাতে দেশের মায়ায় সে ঘর ছাড়লাে। হাতে অস্ত্র নিয়ে
মুক্তিযুদ্ধে চলে গেল সলিম । রাজাকার কমান্ডার আয়েন উদ্দিন তার ঘরবাড়ি
পুড়িয়ে দিয়েই ক্ষান্ত হলাে না, নৌকাটাও ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল হাত বােমা
মেরে ।
যুদ্ধ শেষে
সহায় সম্বলহীন সলিম চোখে অন্ধকার দেখে। নামেই শুধু মুক্তিযােদ্ধা হয়ে
রইলাে সলিম কিন্তু পেটের ভাত যােগাড় করতে পেশা বেছে নিতে হলাে হলো মাছ
ধরা।
কতক্ষণ চিন্তায় বিভাের ছিল সলিমের মনে নেই। দেখতে পেল কলিমুল্লা
হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসছে। কলিমুল্লা তার প্রতিবেশী। তার মতােই চাল-চুলাহীন,
কিন্তু তার জন্য অনেক দরদ। কলিমুল্লা পেছন থেকে রাগত স্বরে চিৎকার দিয়ে
বলে,
তুই একটা মানুষ না কিরে বা, বাড়িত, তাের ছােলডা মােরা গ্যাল, একবার
খোজ খবর লিসনা কিসেক? মরা ছােলডাক দেখার জন্যি সকাল থাকা মানসে বাড়ি ভােরা
গ্যাছে। খালি তুই নাই । তুক খুজা খুজা হামিও মরা গেনু। তুই থাকিস কুটি রে
বা?
বুকের ভেতর ধক করে উঠে সলিমের। অব্যক্ত কান্নার একটা প্রবল ধাক্কা
কণ্ঠনালী পর্যন্ত উঠে আসে। মুহূর্তেই প্রচণ্ড কষ্ট তাকে স্থবির করে দেয়।
হাতের খলুই খসে পরে মাটিতে। ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়ায় সলিম বাড়ির দিকে।
উপােসের ক্লান্তি তাকে শান্ত রাখতে পারে না।
মরা কন্যার কাফনের ব্যবস্থা
হয় প্রতিবেশীদের চাঁদায়। মরিয়ম স্থবির হয়ে বসে থাকে সারাদিন।
সন্ধ্যায়
বাড়িটা খুব ফাকা ফাকা মনে হয় সলিমের। মুক্তির শূন্য বিছানা, কাপড় চোপড়
সব নিথর হয়ে পড়ে আছে। অসুস্থ মুক্তির জন্য ডাক্তার ডাকতে পারেনি সলিম।
সদরের হাসপাতালে একদিন গিয়েছিল সলিম। ডাক্তার সাহেবরা কেউ ছিলেন না। তবে
একজন সিস্টার চারটি ট্যাবলেট দিয়েছিল। আর ওষুধ দোকান থেকে কেনার জন্য লিখে
দিয়েছিল। কিন্তু এ ওষুধ কেনার ক্ষমতা তার ছিল না।
মরিয়ম মাঝে মাঝেই গুন
গুন করে কাঁদছে। আজও তার ঘরে খাবার নেই । সলিমের নিজেকে মনে হয় একজন অক্ষম
পুরুষ। নিজের মেয়ের ওষুধ আর স্ত্রীর পেটের ভাত দেবার ক্ষমতা তার নাই ।
কিসের মুক্তিযােদ্ধা সে? অথচ আয়েন উদ্দিন ব্যাপারি টাকার কুমির হয়ে গেল।
সরকার তাকে কোটি কোটি টাকা লােন দিয়ে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে দিলাে।
রাগে-দুঃখে ঘৃণায় আজ সকালে সে আয়েন উদ্দিন ব্যাপারির দেওয়া মুক্তির
কাফনের কাপড় গ্রহণ করেনি। টিকেট কালােবাজারি রাজাকার আয়েন উদ্দিন আজ
দেশের মাথা। থানা পুলিশ সব তার। স্বাধীনতা দিবসেও সে প্রধান অতিথি । আর
সলিমের জীবন বয়ে চলে নদীর স্রোতে ভেসে আসা মাছের দয়ার উপর। আজ সকালের
কথাগুলাে আবারও মনে পড়ে সলিমের...
ধূর্ত শিয়ালের মতাে সলিমের বাড়ি আসে
আয়েন উদ্দিন। মুক্তির লাশ তখনও গােরস্থানে
নেওয়া হয়নি। পাড়ার সকলে চাদা করে কাফনের কাপড় কিনে আনে। আয়েন উদ্দিন
চারিদিকে চেয়ে জোরে জোরে ডাকে সলিমকে,
হায় হায়রে; সলিম তাের ছােলডা
অকালে মারা গেল টাকার অভাবে । কত কোরা কনু তাের বৌডাক হামার বাড়িতে কামে
দে, তাও থুলুনা, আমি আর কি। করমু। এই লে মাইয়াডার কাফনের কাপড়ের জন্য
কয়ডা ট্যাকা ।
সলিমের মাথায় রক্ত চড়ে যায়। অনেক পূর্ব হতেই মরিময়ের
উপর ব্যাপারির চোখ পড়েছিল সে জানে । সে চিৎকার করে বলে,
ব্যাপারি সায়েব,
আপনার লুটের টাকার কাফনের কাপড় আমার ছােলডা পরবে । আপনি ওডা লিয়া যান ।
আরাে কঠিন কথা শুনানাের ইচ্ছা থাকলেও এভাবেই উত্তর দেয় সলিম।
স্বাধীনতা
সংগ্রামের সময় কত মেয়েকে বেইজ্জতি, কত মানুষ খুন করেছে এই ব্যাপারি তার
হিসাব নেই। তার মুক্তিযােদ্ধা দলই তাে একদিন ব্যাপারির কাফনের কাপড় কিনে
পাঠিয়েছিল। দেশ স্বাধীন হলাে। ব্যাপারি কত হাতে পায়ে ধরে সলিমদের দলের
কাছে জীবন ভিক্ষা করলাে। সলিম তাকে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করে। তার মুখে
চুনকালি মাখিয়ে সারা গ্রাম ঘুরিয়ে আনা হলাে। আর আজ সেই ব্যাপারি তার
কন্যার কাফনের কাপড় কিনে দেয়, স্ত্রীর দিকে কু-দৃষ্টি দেয় ।
নিজের
অজান্তে চোয়ালের হার শক্ত হয়ে উঠে সলিমের। না এবার রাজাকারদের আর ক্ষমা
করা যাবে না। ট্রেনিং তাে এখনও সে জমা দেয়নি নিজেকে সামলায় সলিম । একটা
নিদারুণ হতাশা তাকে পুনরায় আচ্ছন্ন করে। কাল সে খাবে কি? মরিয়মইবা কি
খাবে। তার ঘরে তাে খাবার নাই ।
খুব ভােরে সলিম বুঝতে পারে মরিয়ম বিছানায়
নাই। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরও মরিয়ম ফিরে আসে না। সকাল হয়ে এসেছে। সারা
রাত একটুও চোখের পাতা বন্ধ হয়নি তার। ভােরের দিকে একটু তন্দ্রা এসেছিল।
কলিমুল্লা কিছু ভাত পাঠিয়েছিল। তাই খেয়েছে কাল রাতে । মরিয়ম কিছুই
খায়নি।
আবার চারিদিকে তাকিয়ে সলিম খোঁজ করে মরিয়মের। দেওয়ালে ভােটের
পােস্টার লাগানাে। আয়েন উদ্দিনের নাম স্পষ্ট দেখা যায় । পােস্টারের সব
লেখা চোখে আসে না। তবে... জনদরদী, ফুলের মতাে পবিত্র, লেখাগুলাে পড়তে কষ্ট
হয়। সলিমের । বুক চিরে অযথাই দীর্ঘ নিঃশ্বাস বের হয়ে আসে। হায়রে দেশ!
কত বেইমান তার মানুষ । খুনি রাজাকার তার লুটের টাকায় এখন জনদরদী নেতা
সেজেছেন। আর সলিম মুক্তিযােদ্ধার কন্যার কাফনের কাপড় নেই।
সলিম ক্ষিপ্ত
হয়ে উঠে। ধনুকের মতাে সােজা হয়ে দাঁড়ায় এবং হেচকা টানে ভেঙে ফেলে
পুড়ানাে সুটকেসের মরচে ধরা কম দামি তালা। কাপড়ে জড়ানাে মুক্তিযােদ্ধা
সার্টিফিকেট দুহাতে চোখের সামনে মেলে ধরে। বাসি মুখের এক থােবলা থুথু, থু
করে ছিটিয়ে দেয় তার উপর, তারপর ফর ফর করে ছিড়ে টুকরাে টুকরাে করে ফেলে
সার্টিফিকেট। অভিমান তবুও কমে না তার। পুড়িয়ে ছাই করে দিতে চায় কাগজের
টুকরােগুলাে। রাজাকারের পায়ের নিচে দেশের মান ইজ্জত লুটিয়ে দিয়ে এ
সার্টিফিকেট কি করবে সে। কিন্তু আগুন জ্বালানাের জন্য দেয়াশলাই খুঁজে
পায়না সলিস। সজোরে আধা ভাঙা দরজার হুরকা খুলে বাহিরে বের হয় সে। ঠিক তখনই
স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে যায় সে। পৃথিবীটা দুলে উঠে। আঁধারে ঢেকে যায়
চারিদিকে। মাটি থেকে দুহাত উপড়ে মরিয়মের নিষ্পন্দ দেহ ঝুলে আছে। গলায়
ফাস দিয়ে আত্মহত্যা করেছে মরিয়ম ।




কোন মন্তব্য নেই