নিশি কেমন আছে (নাজমুল হক) ছোট গল্প।
নিশি কেমন আছে
একটা মৃদু ঝাকুনী দিয়ে চলন্ত ট্রেনটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে
গেল। তন্দ্রাচ্ছন্ন চোখের পাতা থেকে ঘুমের সম্ভাবনাটুকু শেষবারের মতাে দূর
হয়ে গেল শহীদের। ঘন কুয়াশায় জমে থাকা আঁধারগুলাে ফিকে হয়ে এসেছে। দু'
একটা বাবলা গাছ গায়ে আবছা আঁধারের চাদর জড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জানালা
দিয়ে বাহিরে দেখার চেষ্টা করে সে। না, কোনাে স্টেশন নয়। মানুষের আবাসনের
চিহ্নও নেই কোথাও। সম্ভবত ইঞ্জিনে গােলযােগ ।
কামরার চারিদিকে রাত জাগা চোখ
ঘুরে আসে একবার। প্রথম শ্রেণীর কামরা। অন্য কোনাে যাত্রী নেই। নীলফামারী
থেকে রাতে যাত্রা আরম্ভ করেছে। রাজশাহী নেমে যাবে শহীদ। সেখানে অফিসের জীপ
থাকবে। তারপর চাপাইনবাবগঞ্জ ।
ঈদের ছুটি শেষ। আগামীকাল হতে আবার কোর্টে
বসতে হবে। মনটা খারাপ হয়ে যায় শহীদের। আবার সেই কোর্ট, চোর, পুলিশ,
ডাকাত, বিচার, জেল। আর ভালাে লাগে না। সব এক ঘেঁয়েমি।
আবার বাহিরে দৃষ্টি
ছুঁড়ে দেয় শহীদ। দু' একজন ফেরিওয়ালা ছাড়া কেউ নেই। পাশে। চা পেলে ভালাে
হতাে। সারা রাতের ক্লান্তিতে শরীর অবসন্ন হয়ে আছে। দরজা খুলে শিশির ভেজা
ঘাসের উপর নেমে দাঁড়ায় শহীদ। চারিদিকে নির্মূপ রাত জাগা সুন্দরী বাবলা
গাছের উদাস অবস্থান। কিছু দূরে কিশােরী আখ ক্ষেতের লাবণ্যময় স্নিগ্ধতা।
গা-ছোঁয়া স্নিগ্ধ বাতাসের অবিরাম বয়ে যাওয়ায় উচ্ছল হয়ে সে। আরাে সামনে
সাদা মাটির গ্রাম্য সড়ক ক্রমাগতভাবে লম্বা হতে হতে দিগন্তে মিলিয়ে গেছে।
তার কাছেই চারিপাশে সরিষা ফুল ঘেরা প্রায় পাশাপাশি দু'টি তালগাছ নিবিড়
স্নেহে নির্বিকার জড়াজড়ি করে দাড়িয়ে আছে। নিচেই একটি যুবতী পুকুর,
তন্বী দেহে কুয়াশার শাড়ি জড়িয়ে, ছােট ঝোপ জঙ্গলকে আঁকড়ে ধরে সকালের
সােনালী আলাের অপেক্ষায় অধীর হয়ে আছে।
শহীদের মন অকারণ আনন্দে শিহরিত
হয়। নিজের আয়ত্তের বাইরে অন্য কোথাও চলে যেতে চায়।
খাকি পােশাক পরা
দু'জন পয়েন্টসম্যান এগিয়ে আসে। তারা বিনা ভূমিকায় জানিয়ে দেয়, আজকে
ট্রেন আর যাবে না ।
জায়গাটি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় হতে সামান্য দূরে।
সামনে প্রায় ৩০০ গজ রেললাইন তুলে ফেলা হয়েছে। আজ বিকেল দুইটা পর্যন্ত
হরতাল ।
অজস্র ভালােলাগার অনুভূতি মুহূর্তেই বিস্বাদ হয়ে যায়। চোখে মুখে
বিরক্তি নিয়ে ব্রিফকেস হাতে তুলে নেয় শহীদ। সময়ক্ষেপণের জন্যই রেললাইন
ধরে হাঁটতে থাকে সামনে।
দিগন্ত প্রসারিত মাঠ। সােনালী মিষ্টি রােদে আকাশ
ভরে আছে। এবারে আরও নিবিড় আগ্রহে চারিদিকে দৃষ্টি মেলে ধরে শহীদ।
তড়িতাহতের মতাে ধাক্কা খেয়ে সােজা দাড়িয়ে পরে সে। দু’হাতে চোখ মুছে
আবার গভীর করে দেখার চেষ্টা করে জায়গাটি। এ জায়গা তার হাজার বছরের চেনা।
পরম স্মৃতি বিজড়িত...
বুকের ভেতর দিয়ে ঝক ঝক করে অবিরাম রেলগাড়ি চলে
যায়। সরিষা খেতের ভেতর অসংখ্য মৌমাছির গুঞ্জন বেজে ওঠে। বাতাসে দুরন্ত
বৈশাখ থর থর কাপে...। শহীদ হারিয়ে যায় পুরানাে অসংখ্য স্মৃতির মাঝে...
দশ
বছর আগে ঠিক এখানেই ঐ তাল গাছের নিচের পুকুর পাড়ে অনেক নির্জন দুপুর,
হাজারাে নিবিড় সন্ধ্যা, আর উদাস শীতের বিকেল অতিক্রান্ত হয়েছে তার। সব
ঘটনাই মনের মাঝে জমে থাকা মলিন ধুলােয় ফিকে হয়ে আছে। এখন প্রতিটি - ঘটনা
বিদ্যুতের ঝলকানির মতাে জ্বলে উঠতে থাকে শহীদের মনে। মনে পড়ে অবুঝ দুটি
হৃদয়ের গভীর অরণ্যে জেগে থাকা স্মৃতি আর অনাবিল আদর সােহাগের কাঙিক্ষত
মুহূর্তগুলাের কথা। সে সব মূহূর্তের নীরব সাক্ষী তালগাছ দুইটি । শহীদের মন
আন- চান করে উঠে, বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই রঙিন দিনগুলাের কথা ভেবে।
সেদিন
পশ্চিমের আকাশ প্রায় সূর্যের সব উত্তাপ শুষে নিয়েছিল । বেলা শেষের রক্তিম
আভা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা
রেইনট্রি গাছের পাতাগুলােকে রঙিন করে দিয়েছিল। শহীদ কার্পেটের মতাে সবুজ
ঘাসে বসে বাসের অপেক্ষায় ছিল। নবীনবরণ অনুষ্ঠান শেষে তখন বাড়ি ফেরার পাল।
এমন সময়ের একাকিত্ব নির্জনে উপলব্ধি করার মধুর বিলাসে ডুবেছিল শহীদ। দূরে
রবীন্দ্র কলা ভবনের আধাে অন্ধকার সিঁড়িতে একজোড়া তরুণ-তরুণী অকারণে
নােটের পাতা উল্টাচ্ছে। উত্তরে রেল স্টেশনের দিকে এগিয়ে যাওয়া মেঠো। পথের
দু'ধারে তুতগাছের সবুজ পাতায় বসে দু’টি ঘুঘু বিষন্ন ভালাে বাসায় মগ্ন ।
একটি কিশােরী শরীরের ছায়ার আঘাতে দৃষ্টি ফেরায় শহীদ।
নিশি...
বিকেলের
সুবাসিত বাতাসে ভেসে এসে পাশে বসে সে । নিশির পুষ্পিত অঙ্গে ফুলের সুবাস।
প্রচণ্ড ডানপিঠে জেদী মেয়ে নিশি । স্বর্গের উপর দিয়ে উড়ে চলে সব সময়।
সে মেয়ের সান্নিধ্যের সাধ্য বিরল। আকাক্ষিত ক্লাসমেটের ছন্দিত আগমনে হৃদয়
ঝংকৃত হয় শহীদের। বিকেলের বিষন্ন আলােয় এক অপূর্ব ভালাে লাগায় চোখ বন্ধ
1 করে সে।
আজ নবীনবরণ অনুষ্ঠানে অদ্ভুত সুন্দর গান গেয়েছেন। আপনি
অনেকের মন কেড়েছেন। হাসতে হাসতে বলে নিশি ।
আপনি হৃদয়বান শ্রোতা, তাই
হৃদয়ের পরশে সবই সুন্দর হয়ে উঠেছে।
নিশির প্রশংসার জন্য সৌজন্যমূলক
ধন্যবাদ দেয় শহীদ। সে সরাসরি নিশির চোখের কালাে দীঘির কালাে জল দেখে। হঠাৎ
করে পৃথিবীটা রংধনু হয়ে যায়। ঘাসফুল, প্রজাপতি, তুচ্ছ বনানীর শ্যামলিমা
সবই গানের মতাে সুন্দর মনে হয়। ততক্ষণে নিশি শহীদের গানের খাতা হাতে নিয়ে
অকারণে খেলা শুরু করেছে। আজ এতদিন পর সে কথা ভাবতে ভালাে লাগে শহীদের।
রেললাইন ধরে হাঁটতে হাঁটতে ফেরিওয়ালার ডাকে চমকে উঠে শহীদ। এত বছর পর কি
ভাবছে এসব সে? আর নিশি? কোথায় সে, কত দূরে? ফেরিওয়ালা আবার ডাকে,
স্যার,
চা খাইবেন? চোখ বন্ধ করে হাঁটনের সময়ে চা খাইতে খুব বলা লাগে।
কৌতুকের
স্বর ফেরিওয়ালার কণ্ঠে,
তাইতাে, অতীত ভেবে কি পাগল হয়ে যাচ্ছে শহীদ।
সবুজ
মাঠ পেরিয়ে কখন নির্জন পুকুরের সেই তালগাছের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার
মনে নেই। একাকী জঙ্গলের মাঝে এভাবে দাঁড়ালে পাগল ভাবতে কারাে অসুবিধা হবে
না। মনে মনে হাসার চেষ্টা করে সে। নিথর পুকুরের কালাে জল এবং তালগাছের
নিচের মসৃণ সবুজ ঘাস তেমনি জরাজরি করে আছে। নিশির দেহের উষ্ণতা এখনও মুছে
যায়নি সেখান থেকে । হৃদয়ের ভেতর প্রচণ্ড কষ্ট অনুভব করে। সে । নিজের
অজান্তেই ঘাসের উপর বসে পড়ে।
নিশি বলেছিল,
তুমি যদি কখনও আমাকে ছেড়ে চলে
যাও তাহলে এই তাল গাছের নিচেই মরে পড়ে থাকবে দেখো।
নিশির সাগর চোখের ভিতর
নিবিড় করে চেয়েছিল শহীদ। সে তার উজ্জ্বল চোখে
অশান্ত উচ্ছল জীবন দেখে। মনে হয় পৃথিবীর আকাশ, বাতাস, ফুল, পাখি সব
মিথ্যা, নিশি ছাড়া তার আর কিছুই চাই না।
যদি তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাও?
নিশির কথার উত্তর না দিয়ে পালটা প্রশ্ন করেছিল শহীদ।
কোনদিন নয়, কখনও
নয়, হাজার বার নয়, কোটি বার নয়, মরে গেলেও নয় । শহীদের বুকে হাত রেখে
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলাে বলে গিয়েছিল নিশি । তারপর উপরের দিকে চেয়ে পুনরায়
বলে,
ঐ তালগাছ সাক্ষী।
উঠে দাঁড়ায় শহীদ। অতীতের স্মৃতিগুলাে আজ একটি
নির্বাক গাছ কেন এভাবে, জানাচ্ছে তাকে? তালগাছের দিকে চেয়ে তার মনে হয়, এ
তালগাছের সেদিনের কথাগুলাে মনে আছে কি?
বুকের ভেতরটা আবারও হুহু করে উঠে।
তিলে তিলে কষ্ট দেওয়ার জন্য স্মৃতিরা অম্লান আছে, অথচ নিশি নেই। লাল
বেনারসীতে নিজেকে জড়িয়ে এই বাঁকা পথের ধুলাে বাতাসে উড়িয়ে একদিন নিশি
চলে গেল স্বামীর বাড়ি। প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্য কিছুমাত্র অনুতপ্ত না হয়ে
নিশি চিরদিনের মতাে তার মনের সীমানা ছেড়ে চলে গেল । শহীদের পৃথিবীতে তখন
অবিরাম কৃষ্ণপক্ষ। তার আঁধারের ধ্রুবতারা শ্রাবণের মেঘে মিয়মান। জীবনের
মেঠোপথ প্রােজ্জ্বল হয় না কখনাে উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় । মৌমাছির " গুঞ্জন
আর ভ্রমরের গান কখনও মুখরিত করে না উষড় মনােভূমি।
শহীদ দূরে, বহু দূরে
দিগন্তের দিকে চেয়ে স্পষ্ট দেখতে পায়, বিকেলের ভার্সিটি ক্যাম্পাস,
প্যারিস রােড, রাতের লাইব্রেরি, দুপুরের বােটানিক্যাল গার্ডেন, কক্সবাজারের
সমুদ্র সৈকত, সুন্দরবনের গভীর অরণ্য, কেন্দ্রীয় উদ্যানের ছায়া ঢাকা পথ,
পদ্মার চর আর নির্জন কলাভবনের ছাদের অনেক স্মৃতি।
মাথার উপর কর্কশ স্বরে
চিল ডেকে উঠে। বাতাসে রােদের উত্তাপ উপলব্ধি করে শহীদ। হাতের ঘড়ির দিকে
তাকায়। হরতাল শেষ । ট্রেন ছাড়ার সময় আসন্ন। শহীদ জোর পদক্ষেপে ফিরে আসে
রেল স্টেশনের অনেক মানুষের ভিড়ে । তবুও দশ বছর আগের নিশির সেই নিস্পাপ মুখ
জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকে মনে। বুকের ভেতর আগুন জ্বলে নিরবে ।
চাকরিস্থলের
নিরস ডরমেটরি কক্ষের একাকিত্বের জ্বালা ব্ৰিত করে তাকে। মনে হয় কোনাে এক
অলৌকিক ট্রেনে চেপে পৃথিবী ছেড়ে সে কোথাও চলে যাবে। সে না থাকলে পৃথিবীতে
কার কি? তার অনুপস্থিতির জ্বালা পৃথিবীর কোনাে কোণ থেকেই অশ্রু সজল চোখে
কেউ কখনও অনুভব করবে না। তবে বেঁচে লাভ কি? দশ বছর আগের নিশি, সবুজ শাড়ি
পরে বাড়ির লেবু গাছের আড়ালে দাঁড়িয়ে আজও চিঠি আসবে কি
দূরের ধান ক্ষেত দেখে? শীতের বিষন্ন বিকেলে মনুজান হলের খােলা জানালায়
উদাস প্রকৃতি দেখার নেশায় কি আজও নিজ সংসারে কাজের অবসরে দূরের কোনাে নিথর
পুকুর অথবা হলুদ সরিষা ক্ষেত শান্ত দুটি হাঁস চোখ মেলে দেখে?
রােমাঞ্চিত
হয় শহীদ। না, নিশ্চয় নিশি আজও তাকে ভুলেনি। স্থির সিদ্ধান্ত নেয়, তাকে
জানাতে হবে, আজও তার পৃথিবী বড় নির্মম। আজও তার বুকে তুষের আগুন দাউ দাউ
করে জ্বলছে। নিশিকে শেষবারের মতাে জিজ্ঞাসা করতে হবে, সে কি সত্যিই সুখে
আছে?
ঢং ঢং করে ঘণ্টা বাজে। ঘড়ির দিকে চায় শহীদ। হরতাল শেষে ট্রেনের আগমন
ঘটবে এখনই। ট্রেন এসে প্লাট ফরমে দাঁড়ায়। শহীদের মনের অস্থিরতা বেড়ে
যায় । বাস্তব জীবনের কঠোর অনুভব তাকে নিজ অক্ষে ফিরে নিয়ে আসে। ব্রিফকেস
হাতে আবার নিজ কামরায় উঠে বসে শহীদ। ধীরগতিতে গন্তব্য পথে এগিয়ে যায়
ট্রেন। পেছনের নিথর পুকুর, হলুদ সরিষা ক্ষেত আর স্মৃতির নীরব সাক্ষী সেই
তালগাছ দুটি ক্রমে 'ছােট হতে হতে এক সময় হারিয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে।
শহীদের জানা হয় না নিশি কেমন আছে।




কোন মন্তব্য নেই